এবার পুজোয় ক'টা হল?

“কীরে এবছর পুজোয় তোর ক'টা জামা হল?”
“চারদিনে চারটে।”
“মাত্র চারটে! আমার কিন্তু ছ'টা।”
ব্যাস্! অমনি মুখ ভার। ছোটবেলায় বন্ধুবান্ধবের মধ্যে এই রেশারেশিটা বোধহয় সকলের জীবনেই থাকত। পুজো এল মানে কতক্ষণে শপিং করতে যাওয়া হবে-এই প্রতীক্ষার পারদ গোণেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। দুর্গাপুজোর সব থেকে আকর্ষণীয় দিক কিন্তু কেনাকাটা।

 

যদিও জীবন এখন মুঠোফোনে বন্দি। তবুও কেনাকাটার ক্ষেত্রে সেই সাবেকি রীতির জুড়ি মেলা ভার। মোবাইলের একটা ক্লিকেই এখন বাড়িতে বসে পাওয়া যায় নামি দামি সব ব্র্যান্ডের পোষাক থেকে শাড়ী। গয়না থেকে জুতো। জীবনের সব প্রয়োজনীয় জিনিসই এখন আমরা ঘরে বসে পেয়ে যাই। করোনা কালে তো এই অনলাইন শপিং-এর বিকল্প নেই। কিন্তু তাই বলে হাতিবাগান বা গড়িয়া মার্কেটে ভিড় কি কম পড়িয়াছে? বরং ছবিটা উল্টো। করোনার বিধিনিষেধকে কার্যত বুড়োআঙ্গুল দেখিয়ে লোকজন মেতে উঠেছে কেনাকাটায়। করোনাকে ডোরো না। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বলে কথা!

Pujabazar1

কিন্তু অনলাইন শপিং-এ একটা বড় মুশকিল হল জিনিসের ছবিটুকুই শুধু দেখা যায়। কিন্তু ম্যাটিরিয়াল পরখ করে দেখার উপায় তো নেই। অনেক ক্ষেত্রে হয় কী যা দেখায় তার চেয়ে খারাপ জিনিস আসে। আবার অনেক অনেক ভালো জিনিসও আসে। তবে রিটার্ন করার অপশন অনলাইন শপিং-এ বেশি হলেও কেনাকাটার সেই আনন্দ নেই। সারা সকাল বা সারা বিকেল ধরে বাজার করতে করতে ফুচকা খাওয়া বা টুক করে কোনও রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ অনলাইন শপিং-এ সেই আনন্দ কোথায়!

 

একটা জিনিস কিনতে হলে অন্তত পাঁচটা দোকান ঘোরা চাই। দর-দাম, কোয়ালিটি সব কিছু পরখ করতে হবে তো। কেনাকাটা কি অতই সহজ ব্যাপার নাকি! আর শুধু জামাকাপড় হলেই হবে? শাড়ীর সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ, ম্যাচিং ব্যাগ, আরও কতরকম 'অ্যাকসেরিস' যে লাগে! সেইসব কী আর অনলাইন শপিং এ করা যায়! করোনা আসায় একটা অসুবিধে অবশ্য হয়েছে।

 

নতুন ড্রেসে নিজেকে ঠিক কেমন লাগছে, শপিং মলের গোপন আয়নায় সেই নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হওয়াটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর সেই ড্রেস যদি কোনও সেলেব্রিটি পরেছে তাহলে তো কথাই নেই। এখন তো আবার মেগা সিরিয়ালের যুগ। হিয়ার কুর্তি, শ্রীময়ীর শাড়ী, বাহা ব্লাউজ, দেশের মাটি পাঞ্জাবি-কেনার জন্য একেবারে সব হামলে পড়ে। যাঁরা সিরিয়াল দেখেন না তাঁরা অবশ্য এইসব সিরিয়াল ব্র্যান্ডের পোষাকের মাহাত্ম্য বুঝবেন না।

 

তারপর সেই নতুন জামা বা নতুন শাড়ি পরে পাড়ার মন্ডপে যখন হঠাৎ করেই বিশেষ কারও সঙ্গে চোখে চোখে কথা হয় সেই অনুভূতিই বা কম কিসের! ‘হৃদয়ের কাছাকাছি প্রেমের সেই প্রথম আনাগোনার’ জন্যই তো দুর্গাপুজো এত প্রিয়।

Pujabazar2

অথচ মাত্র কয়েকবছর আগেকার কথা! তখন মোবাইলও ছিল না। আর ঘরে বসে যে হীরের থেকে জিরে পাওয়া যেতে পারে এই ধারণাও বাঙালির ছিল না। ছিল শুধু পুজোকে ঘিরে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। সেকাল হোক একাল। ছোট্টবেলায় সকলেরই মনগুলো বড় নিষ্পাপ থাকে।

 

তখন কোয়ালিটির বিচার বুঝতাম না। কাজেই জামা-প্যান্ট হানড্রেড পার্সেন্ট কটন না পলিয়েস্টার মিশ্রিত, সেই সব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রশ্নই উঠত না। কত দাম, বেশি না কম সেসব জানার প্রয়োজনও বোধ করতাম না। শুধু পছন্দ হলেই হল। কটা জামা হয়েছে পুজোতে এটাই তখন সবথেকে বড় প্রেস্টিজ ইস্যু ছিল। জামাকাপড় কেনা হয়ে গেলে সব বাচ্চারাই বাবা-মায়ের হাত ধরে ল্যাংবোটের মতো ছোটে জুতোর দোকানে। তারপর সেই নতুন জুতো পরে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পায়ে বেশ বড় বড় ফোসকা পড়লে তবেই না দুর্গাপুজোর আনন্দ।

 

কিন্তু এখন দিনকাল বদলেছে। এখনকার মানুষ কেনাকাটার জন্য পুজো পর্যন্ত আর অপেক্ষা করে না। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সারাবছর ধরেই চলতে থাকে শপিং। তাই পুজোর কেনাকাটা আর এখন বাড়তি উন্মাদনা তৈরী করে না। যার ফলে পুজোটা গৌণ হয়ে গেছে। মুখ্য হয়ে গেছে সাজ পোষাক। কে কাকে টেক্কা দেবে তার কম্পিটিশন। দেশী মুখে বিদেশী ক্রিমের ঝলক, রূপের বাহার আর চুলের ফ্যাশনের দৌলতে ভক্তিরস উধাও।

 

তবুও মা দুর্গা আসেন। অনেক আশা অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে আট থেকে আশি সকলেই। নতুন জামা কেনার যার সামর্থ্য নেই সেও তার সবটুকু না পাওয়া নিয়েই সারাবছর ধরে অপেক্ষা করে থাকে জগত্তারিণীর। নবরূপে। নবসাজে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...