পুজো বলতে এই জেনারেশন যা দেখে, আর আমি যা বুঝি তাতে কিন্তু একটা বিস্তর ফারাক আছে। না, না, তা বলে আমাকে মান্ধাতার আমলের ভাবার কারণ নেই। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এক লহমায় চারপাশের পৃথিবীটা যে বেশ খানিকটা বদলে গেছে, তা বলাই বাহুল্য। আর তাতে আন্তরিকতা, স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব খুব একটা দৃষ্টি এড়ায় না, এ বিষয়ে অনেকেই হয়তো সহমত পোষণ করবেন আবার অনেকে করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।
পুজো এলে আমার কিন্তু বেশ একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। কারণ ছোটবেলার অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তেমনি কিছু ছোট্ট কিন্তু বেশ মজার ঘটনা বলবো।
তার মধ্যে এক হলো পুজোর জামা। এখন ভাবলে কিন্তু বেশ মজাই লাগে, ছোটবেলায় গুনতিতে কার কটা জামা হলো, কটা ওন দ্য ওয়ে, যেগুলো হয়েছে সেগুলো বার কতক খুলে দেখা- এসব কাজ কিছু কম ছিল নাকি?
তার সঙ্গে চলতো হৈ হৈ করে পাড়ার পুজোর ফাংশনের প্রস্তুতি মানে রিহার্সাল। আর এতো কাজের মাঝে অকাজ আর মূল উৎপাতটি ছিল স্কুলের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা, তাও আবার বেছে বেছে শেষ হতো তৃতীয়া বা চুতুর্থীর দিন।
এই এপিসোড বাদ দিলে বাকিটা জম্পেশ অনুভূতি। আর তখন তো জামা হতো ১লা বৈশাখ, পুজো আর জন্মদিনে। কিন্তু এখন সারা বছর ধরেই শপিং পালা চলে, তার সঙ্গে দোসর আবার অনলাইন। আলাদা করে ‘পুজোর কেনাকাটা’ হয় কম, ‘পুজোর শপিং’ হয় বেশি, তাও বছরব্যাপী। সময়ের সাথে আমারও অভ্যাস বদলেছে। যদিও সে বদল নেহাত মন্দ নয়।
এবার বলি পুজোর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আর এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে। পুজোর গান। আমার সময় ক্যাসেটের চল ছিল, যদিও তাও প্রায় অন্তিম লগ্নে। পুজোর গান বলে কিছু বিশেষ গান প্রকাশ পেতো। আর রেকর্ডের সময় তো তার আলাদাই একটা মাধুর্য থাকতো। সারা বছরের অপেক্ষার অবসান হতো এই সময়। থাকতো শোনার তাগিদ।
কিন্তু এখন সারা বছর ধরে এতো শিল্পীর এতো গান, রিলিজ, তার উপর মানুষের হাতে সময় গেছে কমে, আর কত শুনবে! সবারই যেন কি যেন সাংঘাতিক তাড়া! তাই ভালো লাগাটা যেন আর মন ছোঁয় না, তেমন স্বতঃস্ফূর্ত নয়।
এবার আসি ‘থিম’ পর্বে। এখন থিমের কচ্কচি খানিকটা হলেও পুজোর আন্তরিকতাকে ম্লান করে ফেলেছে। যদিও কত শিল্পী তাদের অভিনবত্ব প্রকাশ করার সুযোগ পান উৎসবকে কেন্দ্র করে। কতরকম প্রতিযোগিতা চলে! কিন্তু একচালার, সাবেকি ঠাকুরের মতো কি প্রাণ আছে তাতে? বাহুল্য-আড়ম্বরে যাদের নিয়ে এই বিস্তর আয়োজন, সেই মা দুর্গা আর তার ছানাপোনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হন, আবার কোথাও তাদের এমন বিচিত্র রূপ পরিলক্ষিত হয় যে সেই স্নেহময়ী, চিরাচরিত রূপের লক্ষণটুকু দেখা যায়না। আমার কাছে এই বিষয়টি বেশ পীড়াদায়ক।
এবার বলি বাঙালির বেঁচে থাকার অন্যতম রসদের কথা। হ্যাঁ– নির্ভেজাল আড্ডা। আগেও হতো এখনো হয়, তবে ফারাক হলো সুস্থতার, রুচিশীলতার। এখন সেলফি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে, আধুনিকতার চমকে স্বাস্থ্যকর আড্ডাটা আর তেমন চোখে পড়েনা।
যাইহোক, পুজোর এমনি একটা গন্ধ আছে, যার কোনও পরিবর্তন নেই, করোনা এলেও নেই।
তবে সময়ের পরিবর্তন এসেছে দায়িত্বে। এক সময় যাদের কাঁধে দায়িত্ব থাকতো তাদের চশমার ফ্রেম হয়েছে ভারী, মাথার চুলে ধরেছে পাক, দায়িত্বরাও কাঁধ বদল করেছে।
খানিকটা সময় পেরিয়েছি আমিও- তাই স্মৃতি রোমন্থন হয় আরকি! তবে সময়ের সাথে এগিয়ে একটু নস্টালজিক হতে মন্দ লাগে না।