বাংলা ও বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসবের নাম শারদীয়া। সেই শারদোৎসবেই এবার ইতিহাস তৈরি হতে চলেছে কলকাতায়। সমাজের বদ্ধমূল ধারণাকে ভেঙে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছে ৬৬ পল্লী। দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম সেরা পুজো উদ্যোক্তা এই ৬৬ পল্লী, দক্ষিণের দিশারী। প্রতিবারই তারা কিছু না কিছু নতুনত্ব আনেন তাদের শারদোৎসবের আয়োজনে।
তবে এবারে আর কেবল থিম বা মণ্ডপসজ্জার অভিনবত্বে আটকে থাকেননি আয়োজকেরা। এবার প্রচলিত অচলায়তন ভাঙবেন তারা। এই প্রথম কলকাতার কোন বারোয়ারি পুজোয় মাতৃ আরাধনা করবেন মহিলারা। অর্থাৎ খাস কলকাতায় মায়েদের হাতেই মেয়ের আবাহন হতে চলেছে এইবারের শারদপার্বনে। দীর্ঘদিন ধরে ৬৬ পল্লীতে দুর্গোৎসবে যে পৌরহিত্য করে আসছিলেন তিনি মারা গিয়েছেন। তাই পুরোহিত বদল অভিপ্রেতই ছিল।
কিন্তু কেবল পুরোহিত বদল নয়, এবার তারা বদল করতে চলেছেন সমাজকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এ যেন এক ছক ভাঙার গল্প হতে চলেছে। আগামী ২২ শে আগস্ট ৬৬ পল্লী খুঁটি পুজোর মধ্যে দিয়ে, ২০২১ সালের শারদোৎসবের আয়োজনের শুভারম্ভ করতে চলেছে। তার আগেই উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন এবছর তাঁদের পুজোয় পৌরহিত্য করবেন নন্দিনী, রুমা, সেমন্তী, পৌলমী। হ্যাঁ, তাঁরাই ছক ভাঙছেন। পৌরহিত্যের মতো পেশা থেকে লিঙ্গ বৈষম্যকে দূর করতেই এই উদ্যোগে ব্রতী হয়েছে এই দুর্গোৎসব কমিটি। শারদীয়া মানেই মাতৃ আরাধনা। নারীশক্তির এই বন্দনা এবার নারীদের হাতেই হবে।
দিওতিমা-তে বইয়ের পাতায় বা ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মোটি-তে পর্দায় আমরা ছক ভাঙার গল্প দেখেছি। কিন্তু এই গল্প তৈরি হবে তিলোত্তমার বুকে আমাদের চোখের সামনেই। কলকাতার চার মহিলা পুরুষতান্ত্রিকতাকে ভেঙে আসন্ন দুর্গা পুজোয় ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছেন। যদিও বহুদিন ধরেই প্রথা ভেঙে আসছেন গৌরি ধর্মপালেরা।
৬৬ পল্লীর দুর্গোৎসবে পৌরোহিত্য করবেন মহিলা পুরোহিত নন্দিনী ভৌমিক, রুমা রায়, সেমন্তী ব্যানার্জী এবং পৌলমী চক্রবর্তী। নন্দিনী দেবী, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের এই ছাত্রীটি অধ্যাপিকা এবং পথপ্রদর্শক রূপে পেয়েছিলেন গৌরী ধর্মপালকে। গৌরীদেবীই বেদে উল্লেখিত বিবাহের নিয়মাবলি এবং আজকের সময় উপযোগী নানান বিষয়কে এক সূত্রে গেঁথে, একটি নতুন বিবাহপদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। যার নাম দেন "পুরোনতুন বৈদিক বিবাহ"।
গৌরীদেবীর দেখানো পথেই পৌরোহিত্য শুরু করেন তাঁরা। সেই ছক ভাঙার শুরু। পিছনে ফিরতে হয়নি আর। উপনয়ন, সরস্বতী পুজো, ইত্যাদি নানা পুজো করতে শুরু করেন তাঁরা। পথ খুব একটা মসৃণ ছিল না, নানান প্রতিকুলতা আসে। কিন্তু তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন মনের জোর আর আদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে। দিন পাল্টাতে শুরু হয়। সময়ের নিয়মেই নন্দিনী ভৌমিক ও রুমা রায়দের দল দুই থেকে বেড়ে চারজনের হয়ে গিয়েছে। তাঁদের দলের নাম "শুভমস্তু"। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সেমন্তী ব্যানার্জী ও পৌলমী চক্রবর্তী এখন তাঁদের সহযোদ্ধা।
তাঁদের পৌরহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন আমাদের রবি ঠাকুর। বিয়ের বৈদিক মন্ত্রের সঙ্গেই গাওয়া হয় রবীন্দ্র সঙ্গীত। হ্যাঁ, দুর্গাপুজোর মন্ত্রের সঙ্গেও জুড়ে থাকবেন রবি ঠাকুর। এইভাবেই ইতিহাস তৈরি হোক তিলোত্তমায়। ছক ভেঙে জিতে যাক মানুষ। এগিয়ে যাক আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ। জয় হোক নন্দিনী দেবীদের। শুরুটা না হয় ৬৬ পল্লীই করুক। দেখুক গোটা পৃথিবী। আসুন সবাই বলে উঠি "শুভমস্তু"।