ব্যালকনি বা ছাদবাগানে সহজেই ফলানো যায় ড্রাগন ফ্রুট

ফলের বাজারে গেলে দেখা যায়, দামি ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থানে রয়েছে ড্রাগন ফ্রুট। ড্রাগন আদতে বিদেশি ফল। আগে এদেশে চাষও হত না, খাওয়ার খুব একটা চলও ছিল না। কলকাতায় নিউ মার্কেটে পাওয়া যেত বটে, কিন্তু পাড়ার দোকানে পাওয়া যেত না। তবে পাড়ায়, মফঃস্বলে, জেলার বাজারে আজকাল বেশি না-হলেও এই ফল বেশ পাওয়া যায়। ফ্যাট, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ফাইবার প্রভৃতি বেশ ভালো পরিমাণে থাকায় তরমুজের মতো রসালো ও ক্ষুদে ক্ষুদে কালোজিরের মতো অসংখ্য বীজযুক্ত এই ফলটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তাই ক’বছর হল, এই ফল নিত্য না-হলেও নৈমিত্তিক খাদ্যতালিকায় রাখতে বাঙালি উৎসাহী হয়েছেন। ক্রমে ক্রমে সেই উৎসাহ বাড়ছে।

growing-dragon-fruit-3

ড্রাগন ফল খাওয়ার পাশাপাশি এই ফল চাষেও সাধারণের আগ্রহ বাড়ছে। এই আগ্রহের প্রধান কারণ তিনটি। এক, বাজারে এই ফল বেশ দামি। দেড়শ থেকে আড়াইশো গ্রাম ওজনের এক একটি ফলের দাম পড়ে প্রায় ষাট থেকে একশ টাকা করে। যেখানে এই দামে পেয়ারা বা আপেল সময়ে সময়ে পাঁচশো থেকে আটশো গ্রাম কিনে ফেলা যায়, সেখানে একটি ফলের পেছনে এই ব্যয় মধ্যবিত্তজীবনে একটু বাড়তি খরচ বৈকি! এই খরচ ঠেকানো যায় এবং নৈমিত্তিক খাওয়ার পর্বটিও চালিয়ে যাওয়া যায় এই ফল চাষ করলে। দুই, এই ফল চাষের কথা সাধারণ মানুষ ভাবছেন কেন? শুধুই বেশি দাম বলে? না। আসলে, এই ফলের চাষ অত্যন্ত অল্প পরিসরে বাড়তি কোন যত্ন ছাড়াই করা যায়। তিন, এই গাছ কাঁটাযুক্ত ক্যাকটাসজাতীয় গাছ। তবে ফলের গায়ে কোন কাঁটা থাকে না। এর ফুল অসাধারণ। ফলের সৌন্দর্যও অপূর্ব। ফলে, এদের সমাহারে সাধের বাগান একেবারে সেজে ওঠে।

ড্রাগন ফল চাষের জন্য খুব রোদের প্রয়োজন হয়। দিনে অন্তত পাঁচ ঘন্টা বেশ ভালো রোদ আসে এমন ব্যালকনি বা ছাদবাগানে অনায়াসেই ড্রাগন ফলের চাষ করা যায়। সাধারণত দশ ইঞ্চির টবে নির্ভেজাল জৈব পদ্ধতিতে চাষ করে নিশ্চিন্তে ড্রাগন ফল ফলানো যায়।

ড্রাগনের রঙ ভেদে তিন রকমের জাত রয়েছে। যথাঃ লাল খোসা সাদা শাঁস, হলুদ খোসা সাদা শাঁস, লাল খোসা লাল শাঁস। তাছাড়াও ফলের আকার, স্বাদের প্রকার, গাছের ধরণ প্রভৃতির ভিন্নতার দিক থেকে ড্রাগনের শতাধিক প্রজাতি রয়েছে। এমনিতে সাধারণ জাতের ড্রাগন ফল খেতে কোনটা পানসে, কোনটা বা হালকা মিষ্টি। তবে এর অত্যন্ত সুস্বাদু জাতও রয়েছে। শুধু সেগুলো খুঁজে এনে আপনাকে চাষ করতে হবে এই যা। এই যেমন, লাল জাতের ড্রাগনের মধ্যে ‘মরক্কোন রেড’ জাতের ড্রাগন ফল খেতে বেশ মিষ্টি এবং সুস্বাদু। আবার হলুদ খোসাযুক্ত ড্রাগনের মধ্যে ‘পাল্লোরা গোল্ড’ প্রজাতি সবচেয়ে ভালো। ফুল থেকে খুব ধীরে ধীরে অনেক সময় নিয়ে ফল তৈরি হয়। ফল পাকার পরেও প্রায় দু’মাস ফল গাছে রাখা যায়, নষ্ট হয় না। এই প্রজাতির ফলের গায়ে কাঁটা থাকে। এবং ফল অত্যন্ত সুস্বাদু হয়।

ড্রাগনের বীজ ও কাটিং থেকে তৈরি চারা—যে কোন একটি সংগ্রহ করেই বছরের যে-কোন সময় চাষ করা যায়। দুটোই অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায়। বাজার থেকে কেনা ফলের শাঁস থেকে বীজ ধুয়ে আলাদা করে আলতো শুকিয়ে শাক বোনার মতো করে মাটিতে বুনলেও সাত থেকে দশদিনের মধ্যেই চারা গজায়। সেগুলো একটু বড় হলে প্রথমে ছোট, তারপর বড় টবে প্রতিস্থাপন করতে হয়। বীজ থেকে চারা করে চাষ করার একটাই সমস্যা, তা থেকে ফল পেতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। তাই আমরা অতটা দীর্ঘ অপেক্ষার অপশন মোটেই বেছে নেব না। আমরা কাটিং থেকে তৈরি চারাতেই ড্রাগনের চাষ করব। স্থানীয় নার্সারি থেকে স্থানবিশেষে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ টাকায় একটি ড্রাগনের চারা পাওয়া যায়। অনলাইনে একসঙ্গে তিন থেকে চারটে কেনার অপশন থাকলে তখনই কেবল এতটা সস্তায় পাওয়া যায়। নয়তো দাম অনেকটাই বেশি পড়ে। যাই হোক, যেখান থেকেই চারা নিন না কেন, হেলদি চারা দেখে-শুনে তবেই নেবেন। কেননা, দুর্বল চারার হাল ফেরাতে অযথা সময় নষ্ট হয়। অনেক সময় তা মরেও যায়।

dragon-fruit

চারা সংগ্রহের পর সেটা দিন দশেক বাড়িতে এনে রেখে দিন। আপনার বাড়ির আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাকে এই সময়টুকু দিন। তারপর তাকে টবে বসানোর কথা ভাবুন। ড্রাগন গাছ দোআঁশ মাটি ভালোবাসে। তাই দেড় ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে দেড় ভাগ বালি এবং এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিন। টবের তলায় প্রথমে কুচো পাথর ও বালি দিয়ে তিন ইঞ্চির লেয়ার বানিয়ে নিন জল নিকাশির সুবিধের জন্য। কেননা, ড্রাগন গাছ গোড়ায় জল জমা একদম পছন্দ করে না। খুব বেশি জল সহ্যও করে না। এতে তার গোড়া পচে যায়। তাই পাথর ও বালির লেয়ার বানিয়ে জল নিকাশের ব্যবস্থা। এরই ওপর তৈরি করা মাটি চাপিয়ে টবের আশিভাগ ভর্তি করুন। তারপর মাটির ওপর পরিমাণমতো গর্ত করে তাতে একমুঠো হলুদ ছত্রাকনাশক হিসেবে দিয়ে চারাটি বসিয়ে দিন। তারপর জল দিয়ে আলতো করে টবের মাটি ভিজিয়ে দিন। টবে চারা বসানোর প্রথম দিন থেকেই তাকে রোদে রাখুন, ড্রাগনের ক্ষেত্রে তিনদিন ছায়ায় রাখার দরকার পড়ে না।

ড্রাগনের পরিচর্যায় প্রথম দিন থেকে যে জিনিসটা খেয়াল রাখতে হয় তা হল, জলব্যবস্থাপনা। বাড়তি জল ড্রাগন একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তাই টবে প্রতিদিন জল দেওয়ার দরকার নেই। মাটি শুকোলে তবেই জল দেবেন। এমন পরিমাণে জল দেবেন, যাতে মাটি ভেজা ভেজা হয় শুধু। টব ভাসিয়ে জল কখনই দেবেন না। বর্ষাকালে এবং অসময়ে নিম্নচাপের ফলে টানা বৃষ্টি হলে টব সরিয়ে শেডে রাখতে হবে। নয়তো গাছের কাণ্ডে বা আগার কোন অংশে হঠাৎ পচন ধরে যেতে পারে। যদি কখনো এভাবে পচন ধরে যায় তাহলে তৎক্ষণাৎ পচা অংশটি কেটে ফেলে বা চেঁছে ফেলে সেই অংশে হলুদ লাগিয়ে দিতে হবে পুরু করে। তবে গোড়ায় একবার পচন ধরলে গাছ আর বাঁচানো যায় না। ড্রাগনের মূল অসুখ এই একটাই, ছত্রাকের আক্রমণ। তাই হলুদের পাশাপাশি মাসে দু’বার টবে এক চিমটে করে রাসায়নিক ফাঙ্গিসাইড প্রয়োগ করতে পারেন বাড়তি সতর্কতা হিসেবে।

ড্রাগনের গাছের কোমরে একবারেই জোর থাকে না। সে লতার মতো পর্বের পর পর্ব পেরিয়ে বাড়তে থাকে। তাই তাকে খুঁটি দিয়ে সাপোর্ট দিতে হয়। ব্যালকনিতে গ্রিল থাকলে, সেটা বেয়েও তাকে তোলা যাবে। মোট কথা, তাকে শক্তপোক্ত সাপোর্ট দিয়ে খাড়া রাখতে হবে বা খানিক উঁচু দেওয়াল অথবা ছাদের প্যারাপেটের ওপর গা এলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ফল পাওয়ার জন্য ড্রাগনের কাটিংচারা রোপণের পর থেকে আঠারো থেকে কুড়ি মাস অপেক্ষা করতে হয়। এই দেড় বছরকাল ও তার পরের পরিচর্যা খুব সামান্যই, আর পাঁচটা সাধারণ ফুল গাছে যেমন, তেমনই। চারা রোপণের পনেরো-কুড়ি দিন পর থেকে শুরু হবে এই পরিচর্যা। দশ দিন অন্তর গাছে খাবার দেবেন। পর্যায়টা হবে এরকম, প্রথম দশদিনের শুরুতে সরষের খোল তিনদিন পচিয়ে তাতে যথেষ্ট জল মিশিয়ে পাতলা করে দিলেন তো, পরের দশদিনের শুরুতে সবজির খোসা পনের দিন পচিয়ে সেই জল পাতলা করে গাছের গোড়ায় দেবেন পরিমাণমতো। এভাবেই চলতে থাকবে। গাছের পনেরো মাস বয়স হলে আর একটা বাড়তি জিনিস যোগ হবে, তা হল কলার খোসা পচানো জল। পাকা কলার খোসা পনের দিন পচিয়ে সেই জল পাতলা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে মাসে দু’বার। এতে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, কুঁড়িও আসবে ঠিক সময়ে।

গাছে কুঁড়ি এলে প্রজাতিভেদে তা বেড়ে উঠে পূর্ণাঙ্গ ফুল হয়ে ফুটতে দিন পনেরো লাগে। প্রথম বছর বেশি ফুল হবে না। একটা থেকে চারটে। তারপর প্রতিবছর ফুলের সংখ্যা বাড়বে। একসঙ্গে অনেক ফুল এলেও প্রকৃতির নিয়মেই একেক বারে একটা টবের গাছে শুধু সাত-আটটা ফুল ফলে পরিণত হবে। বাকিগুলো শুকিয়ে অকালেই ঝরে যাবে। ড্রাগনের ফুল দেখতে অসাধারণ। একেবারে সাদা। ব্রহ্মকমল ফুলের মতো তার রূপ। ড্রাগন ফুল একরাতের ফুল। রাতে ফোটে, সকালে বুজে যায়। তারপর শুকোতে থাকে। ফুলের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নেই। এই গাছের ফুলে এমনিতে কৃত্রিম পরাগায়নের প্রয়োজন হয় না। তবে যাঁদের গাছের ফুল ঝরে যাচ্ছে, ফল হচ্ছে না—এমন সমস্যা হয়; তাঁরা করে থাকেন। এক্ষেত্রে রাতে যখন ফুল ফোটে তখন একটা পরিষ্কার কাগজ ও একটা পরিষ্কার তুলি নিতে হবে, ফুলের রেণু তুলি দিয়ে কাগজে ধীরে ধীরে ঝেড়ে, আবার তা গর্ভদণ্ডের মাথায় তুলি দিয়ে মাখিয়ে দিতে হবে। বেশকিছু ফুলের রেণু একসঙ্গে মিশিয়ে এটা করলে রেজাল্ট ভালো হয়।

ড্রাগনের যে ফুল হয়, সেই ফুলের বৃতিটাই ফল হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। সেটা ফলের আকার পেতে ও পাকতে দিন কুড়ি সময় নেয়। ফল পাকার আগে সবুজ খোসা ধীরে ধীরে লাল বা হলুদ হয়ে ওঠে। কাঁচা অবস্থায় খোসা শক্ত থাকে। পাকলে আঙুল ছোঁয়ালেই নরম নরম অনুভূতি হয়। তখন গাছ থেকে ফল তুলতে হয়। খোসাটা কলার খোসার মতো টানলেই উঠে আসে। ভেতরে যা থাকে, সবটাই খাওয়া হয়। সবটাই সরস এবং সুস্বাদের আকর।

কুঁড়ি আসার সময় থেকে ফল পাকার সময় পর্যন্ত গাছে পিঁপড়ের খুব আনাগোনা চলে। এরা সচরাচর খুব একটা ক্ষতি করে না। ক্ষতি করছে বুঝলে গাছের চারপাশে লক্ষ্মণগণ্ডিজাতীয় কিছু দিয়ে গণ্ডি টেনে দিতে পারেন। কীটনাশক একে ক্ষতিকর, তারপরেও স্প্রে-ট্রে করে এদের খুব একটা আটকানো যায় না। জলে কীটনাশক ধুয়ে গেলে এরা আবার আসে।

ড্রাগনের চারা আপনি বাড়িতেও তৈরি করতে পারবেন। আগেই বলেছি যে, এ গাছ পর্বে পর্বে বাড়ে। এই পর্বের সঙ্গে পর্বের যোগ রাখে সরু ইঞ্চি তিনেকের একটি বেশ শক্ত অংশ। এই সরু অংশটিসহ একটি পর্ব কেটে, সরু অংশের দিকটি বালিমাটিতে পুঁতে দিলে এক মাসের মধ্যেই নতুন চারার জন্ম হবে।

তাহলে ড্রাগনের চারা তৈরি, পরিচর্যা সবই যখন সহজ; তখন আর দেরি কেন, নিজের বাগানে একবার চেষ্টা করেই দেখুন না ফলাতে ড্রাগনের ফল। বিশ্বাস রাখুন, নিশ্চিত পারবেন...

  

               

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...