সময়টা ১৮৮৬..কলকাতা শহরে কোনো এক ধনী সন্তানের বিয়ে। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে বিয়েবাড়ি সাজানো হয়েছে। শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষরা সব নিজেদের জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে আসছেন। বিয়েবাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ। তাঁকে দেখে ঠিক ভিখারী বা ঠগ বলে মনে হচ্ছে না। অথচ তিনি প্রত্যেক অতিথির কাছে কিছু অর্থ সাহায্য চাইছেন "আমি একটি হাসপাতাল বানাতে চাই, ডাক্তারি ইস্কুল বানাতে চাই। আপনারা সাধ্যমতো সাহায্য করুন".. প্রথমে কেউ কেউ বললো– "মিথ্যে কথা বলার আর জায়গা পাও না? 'হাসপাতাল বানাতে চাই' বলে লোক ঠকানো? ভাগো এখান থেকে"...
খুব স্বাভাবিক। ক'জন ই বা চেনে তাঁকে। কিন্তু তারপরও তিনি চলে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর যেসব অতিথি এলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে চিনতে পেরে বললেন "ডাক্তারবাবু আপনি"? তারপর তাঁর উদ্দেশ্য শুনে যথাসম্ভব অর্থ সাহায্য করলেন। ডাক্তারবাবুটি নিজে একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার। অথচ একটা মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতাল খুলতে বদ্ধপরিকর তিনি। এজন্য ভিক্ষা করতে ও তাঁর কুন্ঠা নেই।
আজ থেকে একশো কুড়ি বা একশো পঁচিশ বছর আগের কথা।কলকাতায় প্লেগ তখন ভয়ংকর মহামারীর রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্লেগে। সব ভয় তুচ্ছ করে সেই ডাক্তারবাবু দিন রাত প্লেগ রুগীর চিকিৎসা করছেন। রোগীর বাড়ির লোকদের সচেতন হতে বলছেন। নাওয়া খাওয়া ভুলে তিনি মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। এই কাজে তাঁর সাহায্যকারিনী আরেক মহিয়সী...সিস্টার নিবেদিতা।
কখনোই নিজেকে জাহির করতে চাইতেন না। অথচ নিজের সঙ্কল্পে অটল থেকে তৈরি করেছিলেন কলকাতার প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ.. ক্যালকাটা স্কুল অফ মেডিসিন। পরে যেই কলেজ সরকার অধিগ্রহণ করবে এবং এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেডিক্যাল কলেজ হিসেবে পরিগণিত হবে।
জন্ম ১৮৫০(মতান্তরে ১৮৫২) সালের ২৩ শে আগস্ট হাওড়ার রামরাজাতলার কাছে বেতরে। বাবা ছিলেন সেযুগের বিখ্যাত ডাক্তার দুর্গাদাস কর-সেইসময়ের একজন অধ্যাপক এবং গ্ৰন্হকার ও। ঠাকুর্দা ও ছিলেন উকিল। হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশুনা শেষ করে বাবার আদেশে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন তিনি। কিন্তু ডাক্তারি পড়তে পড়তেই অভিনয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। হয়তো তাঁর প্রভাব পড়েছিল জীবনে। হাওড়া ছেড়ে কলকাতাতেই বসবাস শুরু করেন তিনি। ঢুকে পড়েন অভিনয়ের জগতে। কিন্তু তাতে ডাক্তারির পড়াশুনাটাই হোঁচট খেতে শুরু করলো। তিনি পড়াশুনা ছেড়ে পুরোদমে অভিনয়ে মন দিলেন। কিন্তু এই সময় দুটো ঘটনায় তাঁর মন একেবারে বদলে গেল। প্রথম) তাঁকে সম্পূর্ণ বিনা দোষে পনেরো দিন হাজতবাস করতে হলো। দ্বিতীয়) ঠিক সেই সময়েই তাঁর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এই দুটো ঘটনায় তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি আবার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন। পরে বিদেশে গিয়ে ডাক্তারি শিক্ষা সম্পূর্ণ করে দেশে ফিরলেন এবং নিজেকে মানুষের সেবায় সমর্পিত করলেন।
ডাক্তার হিসেবে তাঁর খ্যাতি অর্জন করতে বিশেষ সময় লাগলো না। খুব তাড়াতাড়ি রোগীদের কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন তিনি। ১৮৯০-৯৫ এ কলকাতায় দেখা দিলো প্লেগ। সেই সময় তাঁর ভূমিকা ছিল স্বয়ং ঈশ্বরের। দিন রাত ভুলে মানুষের জন্য কাজ করেছিলেন।
তবে তাঁর সবথেকে বড়ো অবদান মাতৃভাষায় চিকিৎসা শিক্ষার বিস্তার। তিনি বুঝেছিলেন যে বাংলায় যদি চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়া সম্ভব হয় তাহলে বহু মেধাবী বাঙালি ছেলে ডাক্তার হয়ে সমাজের কাজ করতে পারবে। বারবার করে তিনি বলতেন এই কথা। তাঁর বাবা ডাঃ দুর্গাদাস করও বাংলায় চিকিৎসা শাস্ত্রের বই লিখেছিলেন। তাঁর এই ভাবনার সঙ্গে সহমত হন বাংলার আরো বিশিষ্ট ডাক্তাররা– ডঃ নীলরতন সরকার, ডঃ বিপিন বিহারী মৈত্র, ডঃ অক্ষয় কুমার দত্তের মতো মানুষরা। ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় "ক্যালকাটা স্কুল অফ মেডিসিন" যেখানে পঠনপাঠন হতো বাংলায়। এর আগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পড়াশোনা করানো হতো শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু এই বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও পড়াশোনা শুরু হলো। পরে এর নাম পাল্টে রাখা হয়েছিল "ক্যালকাটা মেডিকেল স্কুল"..আর সেই ডাক্তারবাবুই হন এর প্রথম সম্পাদক। মাত্র আটজন ছাত্র নিয়ে যে মেডিকেল স্কুলের কাজ শুরু হয় আজ সেই মেডিকেল কলেজ কলকাতা তথা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই কলেজের নামকরণ করা হয় সেই ডাক্তার বাবুর নামে এবং এটি এখন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল... যাকে আমরা সবাই চিনি "ডঃ আর জি কর মেডিকেল কলেজ" নামে। হ্যাঁ সেই ঈশ্বরপ্রতিম চিকিৎসকের নাম ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর যার স্বপ্নের ফসল হলো আজকের আর জি কর মেডিকেল কলেজ হসপিটাল।
বাংলা ভাষায় তিনি লিখে গেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি বই। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য "ভিষগবন্ধু", "সংক্ষিপ্ত শারীরতত্ত্ব", "রোগী পরিচর্যা", "রোগী পরিচর্যা", "সংক্ষিপ্ত শিশু ও বাল চিকিৎসা".. এবং আরো কিছু। এই বইগুলির প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষের উপযোগী এবং বাংলায় লেখা।
১৯১৮তে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন তিনি। কিন্তু মহান মানবদের তো মৃত্যু হয় না। ডাক্তার রাধা গোবিন্দ কর চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন তাঁর অক্ষয় কীর্তির মধ্যে দিয়ে। ভারত তথা এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেডিকেল কলেজের প্রতিটা ইঁটে, কাঠে, পাথরে অদৃশ্য সোনার অক্ষরে লেখা আছে তাঁর নাম। আজ ২৩শে আগস্ট জন্মদিনে প্রণাম জানাই এই মহান মানুষটির চরণে।