বোধিপথে বাবাসাহেব

বোম্বাইয়ের গলিঘুঁজির ভিতর এক কামরার এক ঘর। ছাগল আর মানুষ ভাগাভাগি করে থাকে। চারদিকে চিৎকার, আওয়াজের ভিড়ে কথা বলারই উপায় নেই, পড়তে বসে সাধ্য কার! তবু সেই এক কামরার ঘরটিতে জন্ম নিত অন্য এক দৃশ্য। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জেগে থাকতেন এক বাবা। ঘড়ির কাঁটা রাত দুটোর ঘরে গেলেই ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিতেন। রাত তখন ক্লান্ত। চারদিকের কোলাহল ঠাণ্ডা। মানুষের স্বর শোনা যায় না সেভাবে। রাতের আঁধারে বাতি জ্বেলে পাঠে ডুবে যেত ছেলেটা। আকাশ ফরসা না হওয়া পর্যন্ত সে ক্লান্তিহীন। স্কুলের খাতায় তার নাম ভীমরাও রামজী আম্বেদকর। বাবা রামজী মালোজী সকপাল।

বোম্বাইয়ের জীবন কিছুটা রেহাই দিয়েছিল ভীমরাওকে। মাঠে গিয়ে ছুটিয়ে ক্রিকেট খেলতে পায় সে। তবে স্কুলের ক্লাসে সাতারার সঙ্গে বিশেষ তফাৎ পায় না সে। তাকে ফার্সি পড়তে হয়, ইচ্ছে থাকলেও সংস্কৃত পড়ার সুযোগ মেলে না। পড়াতে রাজি নয় শিক্ষক! সে যে নীচু জাতের।

১৯০৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ভীমরাও রামজী আম্বেদকর। গোটা মহল্লা তো বটেই নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেই যেন উৎসবের আলোড়ন। সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। জাতপাতের দেশে অস্পৃশ্যতার অপমান মুখ বুজে সহ্য করে পরীক্ষায় পাশ, সে যে বড় সহজ কাজ নয়! আর কয়েক বছর পর ভারতীয় কলেজ শিক্ষা অর্জনে আম্বেদকরই প্রথম দলিত ব্যক্তি’।  

সাতারার ইস্কুলে তার ক্লাসে বসার অধিকারও ছিল না। ক্লাসের বাইরে দূর থেকেই চলত পড়াশোনা। সে যে মহর পরিবারের। মহর সম্প্রদায় তখনকার সমাজে অস্পৃশ্য।

 খুদে ছাত্রটি বেজায় সাহসী ছিল স্কুলে। একবার এক বন্ধু চ্যালেঞ্জ করেছিল তাকে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ছাতা ছাড়া সে স্কুলে নাকি আসতেই পারবে না। করে দেখিয়ে দিয়েছিল ভীমরাও। ডুবো ডুবো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সোজা স্কুলে। জামা কাপড় ভিজে সপসপে।

তার জন্মের সময় গনৎকার বলেছিল, ‘এ ছেলের জন্মে নক্ষত্রের দোষ আছে। ছেলের মা বাঁচবে না।’ সেই ভয় থেকে বাকি ভাইবোনেরা খুব একটা পছন্দ করত না ভাই ভীমরাওকে। মায়ের মৃত্যুর পর এক আত্মীয়ার কাছে বেড়ে ওঠা। তখন জন্মের ঠিক সন তারিখ লিখে রাখার চল ছিল না। জন্মের সময় অসম্ভব গর্ভ যন্ত্রণা  পেয়েছিলেন মা ভীমরাও। রামজী মালোজী সকপাল আর ভীমাবাইয়ের ১৪ সন্তানের মধ্যে ভীমরাও সবচেয়ে ছোট।

বাবা শুরু থেকেই ভীমরাওকে পড়াশোনায় মন দিতে বলেছিলেন। কনিষ্ঠপুত্র ভীম কখনও অন্যথা করেনি।  বাবা রামজী মালোজী সকপাল কবীরের অনুগামী ছিলেন। সন্ধ্যে নামলেই বাড়ির সকলে মিলে চলত নামগান। কখনও কবীর। কখনও মারাঠী সন্ত  তুকারাম। আবার কখন মুকুটেশ্বর।

এহেন বাবা একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন দ্বিতীয় বিবাহের। বাবার পুনর্বিবাহের সিদ্ধান্ত কিছুতেই মানতে পারেনি সে। তাই একদিন বাড়ি থেকে পালাবার সিদ্ধান্ত। ভাবল বম্বে গিয়ে মিলে কাজ করবে। কিন্তু পালাবে যে, গাড়ি ভাড়ার টাকা কই! শেষ পর্যন্ত মাসির ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে পালাবার পরিকল্পনা। কিন্তু ব্যাগের যৎসামান্য তার পথ খরচের ভরসা হয়ে উঠতে পারল না।

নিজের কাজে লজ্জিত ভীমরাও সেই ভাবনা ত্যাগ করে আরও বেশি করে পড়াশোনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল। সেই পথেই ঘুরল জীবনে। ক্লান্তিহীন মেধার চর্চাইয় দিয়েই বন্ধ শিকল আর তালাগু লো খুলতে শুরু করেছিল এক এক করে। সাতারার ছোট্ট স্কুল ছাড়িইয়ে বোম্বাই, বোম্বাই ছাড়িয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ১০০ পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি অন্যতম।      

কিন্তু আশ্চর্য, এ হেন মানুষটি ভরা সভায় স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন,  ‘ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত মেধাবী’ বলে তাঁর সম্বন্ধে যে কথা প্রচলিত আছে তা সঠিক নয়। তাঁর নিজের কথায় ‘ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ’।  

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...