"মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে" ॥
সেই কতোদিন আগে বিশ্বকবি লিখেছিলেন এই গান।.. কী আছে ঐ মহাবিশ্বে, ঐ অনন্ত গগনে-- এই জিজ্ঞাসা তো মানুষের কত কত যুগ ধরে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ভারতও সদ্য স্বাধীনতা লাভ করেছে ব্রিটিশ রাজের থেকে। পৃথিবীর প্রথম সারির দেশগুলোতে পুরোদমে মহাকাশ গবেষণা চলছে। এই সময় এক অতি মেধাবী তরুণ ভারতীয় বিজ্ঞানী ভাবলেন যে আমাদের দেশই বা পিছিয়ে থাকবে কেন। মনে রাখতে হবে তখন ভারত সবে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। নানান সমস্যায় দেশ তখন জর্জরিত। সেই সময়ে অনেকেই এই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে আগে গরীব দেশবাসীদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করার উপরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ কিন্তু তার পরিবর্তে এই ধরনের গবেষণার পিছনে অর্থব্যায় বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে না কি? কিন্তু এই তরুণ বিজ্ঞানী দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে আমাদের দেশকে যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয় তাহলে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে দেশকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতিতেই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। এই তরুন অধ্যাপক-বিজ্ঞানসাধকের নেতৃত্বে, অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ভারতে মহাকাশ গবেষণা ও রকেট প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন হয়। তাঁরই পরিকল্পনার ফসল হলো আজকের ভারতের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান "INDIAN SPACE RESEARCH ORGANIZATION",Bengaluru..
যাকে আমরা ISRO নামেই চিনি। এই তরুণ বিজ্ঞানী গবেষকের নাম বিক্রম সারাভাই, আজ ১২ই আগস্ট তাঁর জন্মদিন।
তাঁর পুরো নাম ছিল বিক্রম আম্বালাল সারাভাই। পিতা আম্বালাল সারাভাই এবং মাতা সরলাদেবী সারাভাই। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট তাঁর জন্ম হয় গুজরাটের আহমেদাবাদে। তাঁদের পারিবারিক কাপড়ের ব্যবসা ছিল এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে এই সারাভাই পরিবার প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছিল। ভারতের বিখ্যাত মানুষেরা যেমন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গান্ধীজী, নেহেরু, মৌলানা আজাদ, এন্ড্রুজ এরা প্রত্যেকেই আহমেদাবাদে সারাভাইদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। এই বিখ্যাত মানুষদের সংশ্রব, তাঁদের জীবন দর্শন বিক্রম সারাভাইকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। গুজরাট কলেজ থেকে বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হয়ে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন তিনি। এরপর বিদেশে লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি ১৯৪৭ সালে ভারতে ফিরে আসেন। দেশে ফিরেই উদ্যোগী হন গবেষণা কেন্দ্র তৈরির কাজে। ঐ বছরই শুরু করেন PHYSICAL RESEARCH LABORATORY (PRL) প্রতিষ্ঠার কাজ। ১৯৫৪ তে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আহমেদাবাদে PRL ভবনের উদ্বোধন করেন।ডঃ সারাভাইয়ের PRL এর গবেষণা সারা পৃথিবীতে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছিল। ১৯৬২তে আহমেদাবাদে গড়ে তুলেছিলেন Indian institute of Management (IIM, Ahmedabad) যেটা ভারতের দ্বিতীয় আই আই এম।
১৯৬২তেই তিনি ভারতে মহাকাশ গবেষণার জন্য তৈরি করেন 'ভারতীয় জাতীয় কমিটি'। পরে এই প্রতিষ্ঠানেরই নাম হয় "ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র" বা ISRO.. যে প্রতিষ্ঠানকে এইসময়ে বিজ্ঞানীরা NASA র সমতুল্য বলে মনে করেন। ১৯৬২তেই বিক্রম সারাভাই দক্ষিণ ভারতের থুম্বায় "থুম্বা ইকোয়টোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন" প্রতিষ্ঠা করেন পরবর্তীতে যার নাম হয় "বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার".. ভারতের পারমাণবিক গবেষণার জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টস প্রতিষ্ঠাতেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। পারমাণবিক গবেষণাকে তিনি শিক্ষা এবং দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত "SPACE APPLICATION CENTRE" এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তাঁরই দূরদর্শিতা, গবেষণা এবং প্রচেষ্টার ফলে ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ "আর্যভট্ট"কে ১৯৭৫এ মহাকাশে কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি এই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালে কেরলের কোভালামে রহস্যজনক ভাবে তাঁর মৃত্যু হয়।
১৯৬৬তে এই বিজ্ঞানতাপসকে পদ্মভূষণ সম্মান এবং ১৯৭২এ মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে "ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নে"র সিন্ধান্ত অনুযায়ী চাঁদের একটি গহ্বরের নাম রাখা হয় "সারাভাই ক্রেটার".. ১৯১৯শে চাঁদের উদ্দেশ্যে যে চন্দ্রযান-২(chandrayan 2) রওনা দিয়েছে তার ল্যান্ডারের নামও বিক্রম সারাভাইয়ের সম্মানে রাখা হয়েছে "বিক্রম" ।
আজ ভারতবর্ষ যে মহাকাশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে এতো উন্নতি করতে পেরেছে তাঁর পিছনে সবথেকে বেশি অবদান তাঁর। আজ, একশো একতম জন্মদিনে "ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার জনক" ডক্টর বিক্রম সারাভাইকে প্রণাম জানাই।