আগের দিন কালী কথায় আমরা হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়ায় হংসেশ্বরী মন্দিরে শেষ করেছিলাম। আজ আমরা হুগলি জেলার আরেক ঐতিহাসিক জনপদ চুঁচুড়া নিয়ে কথা বলব। চুঁচুড়ার ঐতিহাসিক কালী মন্দির হল দয়াময়ী কালী মন্দির। হুগলী জেলার চুঁচুড়া শহরে খড়োবাজার অঞ্চলে নেতাজি সুভাষ রোডের পাশে দয়াময়ী কালীমন্দির অবস্থিত। পাঁচ শতাব্দীর ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে ঐ কালী মন্দিরের সঙ্গে, মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে দয়াময়ী মন্দিরের কালী পুজোর প্রচলন হয়। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে পাঁচশো বছরের পুরনো চুঁচুড়া খড়ুয়াবাজারের দয়াময়ী কালী মন্দির।
মোঘল সম্রাট আকবরের রাজস্বসচিব টোডরমল জিতেন রায় নামক এক ব্যক্তিকে চুঁচুড়া অঞ্চলের জায়গীরদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। ইতিহাস বলে, হুগলি তখন সপ্তগ্রামের অধীনে। সপ্তরগ্রামের শাসক ভৌগোলিকভাবে চুঁচুড়াকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে। চুঁচুড়ার খড়ুয়াবাজার ছিল আশা পরগনার কুলিহান্ডা মৌজায়। টোডরমল এই মৌজার জায়গীরদার অর্থাৎ রাজস্ব আদায়কারী হিসাবে জিতেন রায় নামে এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন। ঐ জিতেন রায়ই সে সময় খড়ুয়াবাজারে দয়াময়ী কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
এই জিতেন রায় ছিলেন শাক্ত সাধক, জিতেন রায় ছিলেন দেবী কালিকার ভক্ত৷ উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরের দুবে বংশের ব্রাহ্মণেরা বংশ পরম্পরায় এই মন্দিরে পৌরহিত্য করতেন৷ প্রথমে রায়দের হাতে পৌরহিত্যের ভার থাকলেও কালক্রমে এই মন্দির রায় পরিবারের হাত থেকে প্রথমে উত্তরপ্রদেশের দুবে পরিবার এবং পরে গোপালরাম পাঠকদের অধীনে চলে যায়। বর্তমানে এই পাঠক পরিবারের পরবর্তী পুরুষেরা দয়াময়ী কালীবাড়ির দ্বায়িত্ব রয়েছেন। দয়াময়ী কালীবাড়ির মূল মন্দিরের পাশে রয়েছে আরও একাধিক মন্দির।
মন্দিরের লাল রঙের দরজার পাশে মার্বেল পাথরের মধ্যে খোদাই করে দয়াময়ী কালী মন্দির লেখা রয়েছে৷ রেখ দেউল স্থাপত্য রীতিতেই এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। যা প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যশৈলীর সাক্ষ্য বহন করে। যদিও কালের নিয়মে মন্দিরের প্রাচীন স্থাপত্যের অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে৷ মন্দির প্রাঙ্গন অনেকটা আয়তাকার৷ কালীমন্দিরের মেঝে শ্বেত পাথর নির্মিত৷ মন্দির গাত্রে লতাপাতা ও লাল ফুল খোদাই করা৷ প্রবেশদ্বারের পরে অনেকটা জায়গা জুড়ে মন্দিরপ্রাঙ্গণ, সেখানেই গম্বুজাকৃতি চূড়াবিশিষ্ট নাটমন্দিরবিহীন দেবীমন্দিরের বাইরে একটি বারান্দা অবস্থিত।
গর্ভগৃহে প্রায় সাড়ে তিন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কালী বিগ্রহ অবস্থান করছে। মাতৃমূর্তি কষ্টিপাথর নির্মিত। দেবী মূর্তিতে হালকা খেয়েরি রঙের আভা দেখা যায়। দক্ষিণা কালীর পদতলে শ্বেত পাথরের শবাসনে আছেন শিব, শবাসনে শিব শায়িত। দেবী ত্রিনয়না। দয়াময়ী মন্দিরে কালী বিগ্রহের মুখ একটু অন্যরকম লম্বাটে এবং মাতৃমূর্তিতে টিকালো নাক রয়েছে। দেবীর চুল হাঁটু পর্যন্ত ছড়ানো। দেবীর ত্রিনয়ন ও জিহ্বা স্বর্ণমণ্ডিত। মূর্তির গলায় নরমুণ্ডমালা ও হাতের খড়্গ রূপার তৈরী।
মন্দিরে রয়েছে কষ্টি পাথরের তৈরি দেবী মূর্তি, যা প্রায় দুশো বছরের পুরনো,যা তদানিন্তন সময়ের ভাস্কর্য শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্দশন৷ দয়াময়ী দেবীর কাছে দয়া ভিক্ষা করতে ও ভোগ নিতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে ভক্তেরা আসেন৷ শোনা যায় আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহ একবার রাজস্থান থেকে এসে এখানে পুজো দিয়েছিলেন৷ বিভীষণা, করালবদনা হয়েও দেবী কালিকা এখানে দয়াময়ী ও করুণাময়ী৷ মন্দিরের প্রতিদিন নিত্যপুজো চলে, এছাড়াও কার্তিকী অমাবস্যা ও মাঘী সপ্তমীতে তিথিতে বিশেষ পুজো হয়৷ দেবী মন্দিরের উত্তর - দক্ষিণে পরপর চারটি শিব মন্দির রয়েছে৷
গম্বুজাকৃতি চূড়াবিশিষ্ট সব ক'টি মন্দিরেই নাটমন্দির নেই৷ সামনেই বড় খোলা প্রাঙ্গন৷ মায়ের ভৈরব প্রথম ও চতুর্থ শিবলিঙ্গে গৌরীপট্ট নেই৷ অন্যদুটিতে গৌরীপট্ট আছে৷ কালী পুজোতে বাৎসরিক পুজো হলেও সরস্বতী পুজোর দু'দিন পর, শুক্লা সপ্তমী তিথিতে এই মন্দিরের মূল বাৎসরিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, ওপার বাংলাতেও একটি দয়াময়ী মন্দির রয়েছে। বাংলাদেশের পটুয়াখালীর গলাচিপার সুতাবাড়িয়া গ্রামের বাংলার ১২০৮ সনে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল।
এই মন্দিরটিও খুবই জাগ্রত। মন্দিরে প্রতিবছর অষ্টমীর মেলা বসে। ওপার বাংলার মন্দিরটিতেও মাঘীসপ্তমী তিথিতে বিশেষ পুজো হয়। মেলা বসে। প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। চুঁচুড়া শহরের খড়ুয়াবাজারের দয়াময়ী মন্দিরটি বাংলার অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দির৷ লোকবিশ্বাসে জাগ্রত এই মন্দিরে, কালী মায়ের দয়া ও কৃপাকরুনা পেতে ভক্তবৃন্দ ভিড় করেন।