কালী কথা: মুর্শিদাবাদের দয়াময়ী কালী মন্দির

সুবে বাংলার প্রাণকেন্দ্র মুর্শিদাবাদ একাধারে যেমন শৈবক্ষেত্র, তেমনই কালীক্ষেত্রও বটে। গোটা জেলাজুড়ে রয়েছে অজস্র কালী আরাধনার পীঠস্থান। বিষ্ণুপুর কালীবাড়ি, দয়াময়ী কালীবাড়ি, জয় কালীবাড়ি, কৃপাময়ী এবং কিরীটেশ্বরী মন্দির অন্যতম। জেলার অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দির হল দয়াময়ী কালী বাড়ি। যা মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুরের মধ্যে অবস্থিত। কতগুলি মন্দির নিয়ে গড়ে ওঠা একটি মন্দিরক্ষেত্র হল দয়াময়ী কালীবাড়ি। কৃষ্ণেন্দ্র হোতা ১১৬৬ বঙ্গাব্দে, ১৭৫৯ সালে দয়াময়ী কালী মন্দির-সহ অন্যান্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

মন্দিরক্ষেত্রের উত্তর দিকের মন্দিরে বিরাজ করেন দয়াময়ী কালী। কৃষ্ণবর্ণের মূর্তিটি অতীব সুন্দর। দেবী জাগ্রতা বলে খ্যাত। দক্ষিণমুখী মন্দিরটি জোড়বাংলা মন্দির স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। যার উচ্চতা প্রায় চল্লিশ ফুট। মন্দিরের থামে, খিলানে ও দেওয়ালে পোড়ামাটির অলংকরণ রয়েছে। মন্দির চত্বরের মধ্যে পূর্বে ছয়টি, পশ্চিমে ছয়টি ও উত্তর মুখে একটি, সব মিলিয়ে মোট ১৩টি শিব মন্দির রয়েছে। কেউ কেউ বলেন শিব চারিপাশে অবস্থান করে রয়েছে, শিব মাকে রক্ষা করছেন। দয়াময়ী কালী মন্দিরের পশ্চিম দিকে এক চূড়াবিশিষ্ট সুদৃশ্য কতগুলি মন্দির রয়েছে। এইসব মন্দিরে রাম-সীতা, রাধাকৃষ্ণ, অন্নপূর্ণা, অর্ধনারীশ্বর পুজো পান। দয়াময়ী মন্দিরের সামনে এক মন্দিরে গ্রহরাজ পূজিত হন। মন্দিরের স্থাপত্য আজও পুণ্যার্থীদের নজর কাড়ে। ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে। ফি অমাবস্যাতেই ভিড় হয়। কার্তিক মাসে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়ে থাকে। মায়ের পুজো দেখার জন্য রাত জাগেন পুণ্যার্থীরা। লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়।

প্রাচীন সৈদাবাদের মধ্যে ১৭৬৬ নাগাদ কৃষ্ণেন্দু হোতা প্রতিষ্ঠা করেন শিব মন্দির-সহ কালী মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে কোনও রকম বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সারা বছরই মোমবাতি ও প্রদীপের আলো জ্বেলে পুজো চলে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, দেবী মা নাকি আলো সহ্য করতে পারেন না। মায়ের মন্দিরের বাইরে বিদ্যুত্‍ সংযোগ থাকেলেও মূল মন্দিরের ভিতরে কোনও বিদ্যুত্‍ সংযোগ নেই। জনশ্রুতি রয়েছে, একবার মন্দিরের ভিতরে বিদ্যুত্‍ সংযোগের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। সেই রাতে মা মন্দিরের সেবাইতকে স্বপ্নাদেশে বিদ্যুত্‍ সংযোগ না-করার জন্য নির্দেশ। তারপর থেকে মন্দিরের ভিতরে বিদ্যুত্‍ সংযোগ করা হয়নি। সারা বছর ধরে মায়ের মন্দিরের ভিতরে মোমবাতির আলো জ্বালানো হয়। প্রতিষ্ঠা মাস বৈশাখে এবং কালী পুজোর সময়েও মোমবাতির আলো দিয়েই মায়ের মন্দির সাজানো হয়।

কৃষ্ণেন্দু হোতা ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নায়েব। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন কালী সাধক। তিনিই মন্দির সহ মা-এর মুর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ২৭০ বছর আগে সাধক কৃষ্ণেন্দু হোতা মায়ের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তাঁরই নির্দেশে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কন্যার মৃত্যুর পর কৃষ্ণেন্দ্র হোতা সংসার ত্যাগ করেন। বাকি জীবন কালী সাধনায় মগ্ন থাকেন তিনি। কৃষ্ণেন্দ্র হোতা ১১৮৭ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে পরলোক গমন করেন। তাঁর স্ত্রী ভৈরবী কৃষ্ণ কামিনী দেবী বিষ্ণুপুর শ্মশানে সিদ্ধ লাভ করেন বলে শোনা যায়। কৃষ্ণেন্দু হোতার পর তাঁর পুত্র আনন্দ চন্দ্র হোতা ও পৌত্র শিবনাথ হোতা দয়াময়ী কালী মন্দিরের সেবাইত ছিলেন। আজ আর হোতা বংশের কারও সন্ধান পাওয়া যায় না।

মন্দিরের নির্মাণকাল ১১৬৬ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ। দক্ষিণমুখী জোড়বাংলা মন্দির ত্রিখিলান যুক্ত। তিনটি প্রবেশদ্বার, এছাড়াও পূর্ব ও পশ্চিমে আরও দুটি দ্বার রয়েছে। মন্দির কালী মূর্তিটি শিবের উপর অধিষ্ঠিত। এই মন্দিরকে অনেকেই মুর্শিদাবাদ জেলার বৃহত্তম চারচালা মন্দির বলে অনেকে মনে করেন। প্রায় ৪০ ফুট উঁচু মন্দিরের আশপাশে পৌরাণিক দেবদেবী, দশাবতার, লঙ্কাযুদ্ধ ও ফুলবাড়ি নকশা রয়েছে। এখানে মায়ের শিলা মূর্তি রয়েছে।

প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবারে ভক্তের সমাগম হয় এবং পুজো পাঠ দিয়ে থাকেন। কালী পুজোর দিন মহাসমারোহে পুজো হয়। দীপান্বিতা অমাবস্যার দিন সকাল থেকেই মায়ের মন্দিরে পুজোপাঠ যাগযজ্ঞ শুরু হয়। দর্শনার্থীরা সকাল থেকে পুজো দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এছাড়াও মন্দিরে মায়ের নিত্য পুজো হয়। মায়ের নিত্য ভোগে মাছ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী বৈশাখ মাসে, পৌষ মাসে মায়ের মন্দিরে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। কেবল মুর্শিদাবাদ জেলায় নয়, রাজ্য বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে আসেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...