উত্তর সাইবেরিয়ার হাড় হিম করা ঠাণ্ডায় ওদের বসত। বল্গা হরিণের ব্যবসায় মানুষগুলোর গুজরান।জাখার আর প্রকোপি । একজনের বয়স সাত। আরও একজনের নয়। উত্তর সাইবেরিয়ার প্রান্তিকে তেইমির পেনিনসুলায় শহুরে সভ্যতা থেকে অনেক ক্রোশ দূরে বেড়ে উঠছে তারা। হিমেল বরফে ঢাকা চারপাশ। কঠিনকে দেখে, কাঠিন্য আগলিয়েই এগিয়ে চলেছে তারা।বাবা-কাকাদের জীবিকাতেই মন। সেটাই উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তাবে তাদের উপর। তবে একইসঙ্গে চলছে পড়াশুনোও। একটা সময় ছিল যখন এদের মত অনগ্রসর গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা সুযোগ পেত শহরে গিয়ে পড়বার। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে একবার গেলে আর হতনা ফেরা। শহুরে ঘেরাটোপে ভুলতে হত শৈশবের ছায়া ।
নতুন সরকারী নীতি চলমান স্কুল -র দরুণ আজ ওদের ছেলেমেয়েরা আর বঞ্চিত হয়না পড়াশুনো থেকে। কাজেই হরিণ এর পাল দেখাশোনা করার ফাঁকে ফাঁকেই চলে অঙ্কের হিসেবনিকেশ। সরকারী তরফে পাঠানো হয়ে থাকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক।ডলগান। প্রায় এক হাজার বছর আগের এক জনসম্প্রদায়। পৃথিবীর প্রান্তিক মানুষ। ডলগান শব্দের আক্ষরিক অর্থ জলের মাঝে পৌঁছতে পারে এমন কেউ।মাছ ধরার শখ থাকলেও,জলে তাদের যাতায়াত নেই বিশেষ। প্রধান জীবিকা বল্গা হরিণ চাষ। ঐতিহ্যবাহী এই কারবারে তাদের সুনাম রয়েছে যথেষ্ট।
এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কম সংখ্যক মানুষের বাস মেরু অঞ্চলে। অধিকাংশ এলাকা হয়ে থাকে জনমানবশূন্যও। এক জমাটবদ্ধ সাগরকে ঘিরে এক সুবিশাল মহাদেশীয় সভ্যতার পত্তন। অন্যান্য অঞ্চলগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাইবেরিয়া আয়তন ও ঠাণ্ডার বিচারে এগিয়ে আছে সবার আগে।সেখানেই তান্দ্রা নামক একটা অঞ্চল জুড়ে বসবাস এদের। ডলগানদের জীবনযাত্রায় আদিমতা দেখা যায় আজও। নিজেরাই চলেছে বয়ে নিয়ে। সাইবেরীয় অঞ্চলের রক্ত বরফ করা শীতে টিকে থাকার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে বল্গা হরিণ। যে কোনও মাত্রায় শীত সহ্য করতে এদের জুড়ি মেলা দায়।
এই বল্গা হরিণদের দিনলিপিও বেশ অদ্ভুত রকমের। এদের সঠিকভাবে পোষ মানিয়ে বশে আনতে পেরেছে এমন মানুষ নেই বললেই চলে। বরফের চাদরের নিচে চাপা পড়ে থাকা ঘাস খেয়ে এরা কাবার করে এক একটা দিন।তাহলে প্রশ্ন হল ডলগান আর বল্গা হরিণের সম্পর্কের গভীরতার ভিত্তিটা কী? কোন এমন মাধ্যম যা এই দুই প্রাণীদের চরাচরের মাঠ হয়েছে! রহস্যের কিনারা লুকিয়ে আছে তাদের খাওয়ারে। মানে সেই বরফের নিচের ঘাস।
বুদ্ধিতে ক্ষুরধারী ডলগানরা ফাঁদের দড়িটা আটকেছে সেখানেই। বরফে ঢাকা পড়ে থাকা ওই ঘাস গুলি সংগ্রহে বল্গা হরিণদের রাস্তা দেখায় ডলগানরা। ব্যস, হয়ে গেল বন্ধুত্ব। জনঘনত্বের হিসাবে প্রত্যেক গ্রাম পিছু দুটো করে পরিবারের বসবাস। তাপমাত্রার পারদ সবসময়ই নিচের দিকে।কাজেই সমস্যা হয়না খাওয়ার সংরক্ষণে। আর ডলগানরা গায়ে গলিয়েছে বল্গা হরিণদের চামড়া। নাহলে যে টিকে থাকা অসম্ভব। ওই মোটা পশমের চামড়া প্রবল শৈত্য প্রবাহকেও মানায় হার।
ছোট ছোট খুপরির মত ঘর গুলোকেও ঠাণ্ডা নিরোধক করতে এই চামড়াই ভরসা। অথচ বিশেষ অচলাবস্থা না এলে কিন্তু এরা বল্গা হরিণদের সংহার করেনা। রক্ষা করেই চলে। সাইবেরিয়ার বরফগলা জমে জমাট বেঁধে থাকা শুকনো মাছই এদের প্রিয় খাদ্য। যাযাবরের জীবন ওদেরও। বেঁচে থাকার আশা ভরসা বল্গা হরিণদের বাঁচিয়ে রাখতে তাদের খাদ্য ঘাসের খোঁজে ফি সপ্তাহেই আস্তানা বদলাতে হয় ডলগানদের। হরিণের পাল চলে পিছন পিছন।
নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছলে আগেই বেঁধে ফেলে হরিণগুলোকে। ওরা না থাকলে যে এই প্রশিক্ষণ তাদের পূর্ব পুরুষ অধিকৃত। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় হরিণই হয় তাদের প্রধান যান। শত শত মাইল ভ্রমন করে এভাবেই। এক হরিণের দৌলতেই এই অঞ্চলের খোঁজ পায় সকলের প্রথম ডলগান।অর্থাৎ বসতি স্থাপনের পিছনেও ডলগানরা ঋণী বল্গা হরিণদের প্রতি।তবে ভালো থাকার দিন তাদের ভাঁড়ারে অবশিষ্ট নেই বিশেষ।
জলবায়ুগত পরিবর্তনের পাশাপাশি জলের নিচে খনিজ পদার্থ গুলির নানান বিক্রিয়ায় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তারা। লাল হয়ে যাচ্ছে জলের রং। এছাড়াও বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে মেরু প্রদেশের বরফ গলনের ফলে তৈরি সমস্যাগুলি তো সকলেরই জানা। বন্যপ্রাণী শিকার, জায়গা অধিগ্রহণ,মেরু দেশের খনিজ ভান্ডারের দিকে বিশ্বব্যাপী কুনজরে ডলগানদের আজ টেকা দায়।