বাংলার নানা রাজবাড়িতে কীভাবে পালিত হয় দোলযাত্রা?

কবি গোবিন্দদাস লিখে গিয়েছেন,
‘খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ।।
ঋতুপতি মনমথ মনমথ ছান্দ।
সুন্দরীগণ কর মণ্ডলি মাঝ।
রঙ্গিনি প্রেম তরঙ্গিনী সাজ।।
আগু ফাগু দেই নাগরি-নয়নে।
অবসরে নাগর চুম্বয়ে বয়নে।।’

দোলযাত্রা প্রকৃত অর্থেই কৃষ্ণের উৎসব। দেবতার পায়ে ফাগ অর্থাৎ গুঁড়ো রঙ (আবির) দিয়ে রঙ খেলা আরম্ভ হয় বাঙালির, তারে মিশে থাকে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ি থেকে মুর্শিদাবাদে দেবী সিংহের নশিপুর রাজবাড়ি; বাংলার প্রতিটি রাজবাড়িতেই দোল পালিত হয়। বাংলার জমিদার, রাজারা দুর্গা, কালী, অন্নপূর্ণার আরাধনার পাশাপাশি কৃষ্ণের পুজোও করতেন। গোপীনাথ হোক বা রাধাবল্লভ, গৃহদেবতার আসনটি পাকা ছিল কৃষ্ণের জন্য। ফলে জাঁকজমকপূর্ণভাবে দোল উদযাপন হত। আজও তা চলে আসছে।

শোভাবাজার রাজবাড়ির দোল:

রাজা নবকৃষ্ণ দেব, ১৭৬৬ নাগাদ তাঁর ঠাকুরদালানে গোবিন্দ জিউর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। আজও শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাধাগোবিন্দের দোল উৎসব পালিত হয়ে চলেছে। দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় চাঁচর হয়। যার আর এক নাম বহ্ন্যুৎসব। দোলের দিন সকালে হয় দেবদোল। পুজোর পর নারায়ণকে ফাগ বা আবির দেওয়া হয়। তারপর হয় নারায়ণের অভিষেক, বিভিন্ন তীর্থের জলে তাঁকে স্নান করানো হয়। এরপর রাধাগোবিন্দজিকে দোলনায় দোলানো হয়। মতিচুর, দরবেশ, পান্তুয়া, মিষ্টি গজা, নোনতা গজা ও খাস্তা কচুরির ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগের পর রাধাগোবিন্দকে আবির দেওয়া হয়। দোলখেলার শেষে রাধাগোবিন্দর স্নান হয়। বিগ্রহের গায়ের আবির পরিবারের সবাই মাথায় নিয়ে রাধাগোবিন্দকে প্রণাম করেন। কলকাতার প্রাচীন দোল উৎসবগুলির মধ্যে এটি অন্যতম।

জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির দোল:

বৈকুন্ঠপুরের রাজ পরিবারের দোল পাঁচশো বছরেরও বেশি প্রাচীন। দোলের দিন মন্দির থেকে নাটমন্দিরে সবার মাঝে নেমে আসেন বৈকুণ্ঠনাথ। তাঁকে সামনে রেখেই হয় রঙ খেলা চলে। আটদিন ধরে চলে উৎসব। দোল পূর্ণিমায় রাজপরিবারের কুলদেবতা বৈকুণ্ঠনাথ এবং গোপাল ঠাকুরের বিগ্রহকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে দোলনায় বসানো হয়। প্রতিপদ তিথিতে পালকি সওয়ারি হন তাঁরা। দুই দেবতাকে দোলনায় বসিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরানো হয়। তারপর বিগ্রহকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজবাড়ির পুকুরে। একদা হাতির পিঠে চড়তেন বৈকুন্ঠনাথ। রাজবাড়ি থেকে হাতির পিঠে চাপিয়ে সোনার বৈকুন্ঠনাথ, মদনমোহন সহ অন্যান্য দেবদেবীদের নিয়ে যাওয়া হত রাজঘাটে। তাঁদের স্নান করিয়ে পুজো হত। তারপর বিগ্রহ আসত নাটমন্দিরে। সেখানে দোলনায় রাখা হত বিগ্রহ। আটদিন পর হাতির পিঠে চেপেই রাজবাড়িতে ফিরে যেতেন বৈকুন্ঠনাথ।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বারোদোল:

উলাগ্রামের (অধুনা বীরনগর) দেবী হলেন উলাইচণ্ডী৷ দেবীর বার্ষিক পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। এই মেলায় সববর্ণের মানুষ বলে, মেলার নাম হয়েছিল জাতের মেলা৷ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বিতীয় রানি বায়না ধরলেন মেলায় যাবেন। মহারাজ সে'কথা বেমালুম ভুলে যান। জাতের মেলা দেখা শোভনীয়ও ছিল না রানির জন্য। রানি রাগ করে বসেন। রাজমহিষীর মান ভাঙাতে রাজা মেলা বসিয়ে ফেলেন রাজবাড়ির মাঠে। সেই মেলাই বারোদোলের মেলা। তবে মেলা শুরু দিনক্ষণ জানা যায় না নির্দিষ্ট করে। তবে ১৭৫২-র আগে নয়। কারণ, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের লেখা অন্নদামঙ্গলে বারোদোলের উল্লেখ নেই। রায়গুণাকর ১৭৫২ সালে অন্নদামঙ্গল লেখেন। তারপরেই প্রথম বারোদোলের মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

কেবল আবদার রাখতেই মেলা নয়। মেলা শুরুর আগে কৃষ্ণচন্দ্র হয়তো শাস্ত্রজ্ঞদের মত নিয়েছিলেন। ‘হরিভক্তিবিলাস’ গ্রন্থে এই দোলের উল্লেখ পাওয়া যায়।

চৈত্রে মাসি সিতে পক্ষে দক্ষিণাভিমুখং হরিম।
দোলরূঢ়ং সমভ্যরচ্য মাসমান্দোলয়েৎ কলৌ।।
চৈত্র মাসে শুক্লা একাদশী তিথি থেকে এক মাস নৃত্যগীত সহকারে দেবদেবী বিগ্রহকে পূজার্চনা করে দক্ষিণমুখী করে দোলনায় দোলাতে হয়। গরুড় পুরাণেও এর উল্লেখ রয়েছে।

নদিয়ারাজ শাস্ত্র মেনেই সূচনা করেছিলেন বারোদোল উৎসবের। বারোটি বিগ্রহের দোল তাই নাম বারোদোল। নদিয়ার রাজবাড়ির কুলবিগ্রহ হল বড় নারায়ণ। বড় নারায়ণের সঙ্গে বারোদোলে আরও বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহ থাকে। সব মিলিয়ে মোট তেরোটি বিগ্রহ থাকে। তাঁরা হলেন বলরাম, শ্রীগোপীমোহন, লক্ষীকান্ত, ছোট নারায়ণ, ব্রক্ষণ্যদেব, গড়ের গোপাল, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ, নদিয়া গোপাল, তেহট্টের কৃষ্ণরায়, কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রী গোবিন্দদেব ও মদনগোপাল। বিগ্রহগুলি বিরহী, শান্তিপুর, সূত্রাগড়, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, তেহট্ট, বহিরগাছি প্রভৃতি স্থানের। এখন আর সব বিগ্রহ রাজবাড়িতে আসে না। তেহট্টের কৃষ্ণরায় বিগ্রহ আসা বহুদিন আগে বন্ধ হয়েছে। অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের বিগ্রহও পাঠানো হয় না। তাই গোপীনাথের বিগ্রহের বদলে এখন বিগ্রহের ফটো রাখা হয়।
বারোদোল উপলক্ষ্যে ১২টি মন্দির থেকে বিষ্ণুর দ্বাদশ বিগ্রহ এনে রাজবাড়িতে সাড়ম্বরে পুজো করার ব্যবস্থা করেন। রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে এক মাস ধরে মেলা বসে। দাবি করা, বিগ্রহগুলি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই বিভিন্ন স্থানে মন্দির নির্মাণ করে স্থাপন করেছিলেন৷ (যা পুরোপুরি সত্য নয়। কিছু কিছু মন্দির তিনি সংস্কার করেছিলেন। কয়েকটি বিগ্রহ তাঁরই স্থাপন করা।) বারোদোলের সময় তিন দিনের জন্য আনা হয়। তিন দিনে দেবতাদের তিনরকম সজ্জা। প্রথম দিন রাজবেশ, দ্বিতীয় দিন ফুলবেশ আর তৃতীয় দিন রাখালবেশ।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সুবিশাল ঠাকুর দালানেই বারোদোলের মূল মঞ্চ গড়া হয়।।


গড়বেতার বগড়ি রাজবাড়ির দোল:

পশ্চিম মেদিনীপুরে শিলাবতীর উত্তরদিকের গ্রাম কৃষ্ণনগরে, বগড়ি রাজ পরিবারের বসবাস ছিল। কৃষ্ণরায়জিউয়ের মন্দিরটি ১৮৫৫ সালে নির্মিত। শোনা যায় প্রথমে রাধিকার মূর্তি ছিল না, পরে ১৯২০-'২৫-র মধ্যে শ্রীরাধিকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকেই প্রতি বছর দোলের সময় উৎসব ও মেলা হয়। এখন রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি। দোলের আগের রাতে প্রথা মেনে হয় চাঁচর। বাজি পোড়ানো হয়। শোভাযাত্রা বের হয়। বিগ্রহকে পালকিতে চাপিয়ে গোটা এলাকা পরিক্রমা করা হয়। পূর্ণিমার দিন হয় মূল উৎসব। এদিনও বিকেলে পালকিতে দেবতার বিগ্রহ নদী পেরিয়ে দক্ষিণে রঘুনাথবাড়ি গ্রামের মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। দ্বিতীয়া তিথি পর্যন্ত বিগ্রহ থাকে। পুরনো মন্দির সংলগ্ন আম বাগানে ১০ দিন ব্যাপী মেলা বসে। সাতদিন পরে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ রঘুনাথবাড়ি মন্দির থেকে পালকিতে চাপিয়ে নদী পেরিয়ে কৃষ্ণনগরের মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...