হিন্দুতন্ত্রশাস্ত্রে ব্রহ্মার ‘শক্তি’রূপে স্থান পেয়েছেন সরস্বতী। সেখানে তাঁর অন্যতম নাম, ‘বাসলী’। ‘বাগীশ্বরী’ শব্দ থেকে ‘বাসলী’ নামের জন্ম। বীরভূমের নানুরে এই বাসলী দেবীর একটি মন্দির আছে। সেখানে অধিষ্ঠিতা আছেন মাতৃময়ী দেবী সরস্বতী। এই দেবীর থানে পশুবলি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল কয়েকবছর আগেও। এখন আছে কিনা জানিনা। বলি দেওয়া হত দুর্গাপুজোর সময়, সপ্তমী থেকে নবমী। এমনকি বছরের অন্যান্য সময়ও, মানত পূরণে কেউ দিতে চাইলে বলি হত। এই বিদ্যাদায়িনী দেবীর থানে এই যে বলি দেওয়ার রীতি, এর উপাখ্যান বেদ-পরবর্তী সাহিত্য ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’ আছে।
ইন্দ্রের সাথে একবার ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপের বিবাদ হয়। সেই বিবাদে ইন্দ্রের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু হয় বিশ্বরূপের। রাগে-শোকে পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য ছটফট করতে থাকেন ত্বষ্টা। সুযোগও মিলে গেল। ইন্দ্র যখন একদিন যজ্ঞের আয়োজন করলেন, তখন যজ্ঞের আবশ্যিক সোমরসের মধ্যে ত্বষ্টা কৌশলে মিশিয়ে দিলেন ওষুধ। ইন্দ্র সেই সোমরস পান করে এমন উন্মত্তের মতো আচরণ করতে শুরু করলেন যে, যজ্ঞ পণ্ড হয়ে গেল। ইন্দ্রের তখন মারাত্মক অবস্থা। তাঁর সারাশরীর ফেটে বীর্যপাত হতে লাগল। তাঁর সমস্ত তেজ, শক্তি, মনোবল সব নষ্ট হয়ে গেল। তিনি মরণযন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলেন।
ইন্দ্রের পরমশত্রু অসুর নমুচি এই অবস্থায় ইন্দ্রকে হাতে পেয়ে মস্ত এক চাল চালল। জাদুমদ্য পান করিয়ে সোমরসের মারণযন্ত্রণা থেকে ইন্দ্রকে বাঁচিয়ে দিল, কিন্তু, তাঁর সামান্যতম ক্ষমতাও অবশিষ্ট রাখল না। তারপর নমুচি হয়ে উঠল স্বর্গের অধীশ্বর। তখন ইন্দ্রকে সারিয়ে তোলার জন্য পরাধীন দেবতারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
স্বর্গে তখন বৈদ্য হিসেবে দুই অশ্বিনীকুমারের যেমন সুনাম, তেমনি দেবী সরস্বতীরও খ্যাতি। দেবতারা মানত করলেন যে, ইন্দ্রকে সারিয়ে তুলতে পারলে অশ্বিনীকুমারদের পুজোয় ছাগল এবং সরস্বতীর পুজোয় ভেড়া বলি দেবেন। মরণাপন্ন ইন্দ্রও তাঁদের শরণাপন্ন হলেন। নমুচির সঙ্গে তাঁর নাকি চুক্তি হয়েছিল দিন বা রাতে, দণ্ড-ধনু-মুষ্টি-অসি-গদা-ভাল্লা এবং তরল বা কঠিন প্রভৃতি কোন অস্ত্রেই তাকে বধ করবেন না। আর নমুচিও কথা দিয়েছিল স্বর্গের দিকে ফিরে তাকাবে না। কিন্তু, বেইমানটা তবুও ছলনা করে সুযোগ বুঝে ইন্দ্রকে জীবন-মৃত্যুর দোরে পৌঁছে দিল, স্বর্গ কেড়ে নিল! সুস্থ হয়ে ইন্দ্র চান এর প্রতিশোধ নিতে। সেই আকাঙ্ক্ষার কথাই দুই বৈদ্যের কাছে নিবেদন করলেন ইন্দ্র।
সব শুনে সরস্বতী সৃজন করলেন ‘সৌত্রামণী’ নামের যজ্ঞ-অনুষ্ঠানের। এই যজ্ঞ সম্পন্ন করে ইন্দ্র সুস্থ হয়ে উঠলেন। তখন অশ্বিনীকুমারদ্বয় ও সরস্বতী বরফ দিয়ে বজ্র তৈরি করে দিলেন। তখন ইন্দ্র নমুচিকে হত্যার আয়োজন শুরু করলেন। রাত শেষ হয়ে আসছে কিন্তু সূর্যও ওঠেনি--এমন সময় না-তরল না-কঠিন অস্ত্র বরফের বজ্র দিয়ে নমুচির মাথা উড়িয়ে দিয়ে হত্যা করলেন ইন্দ্র। তখন দেবতারা স্বাধীন হলেন, ইন্দ্রও ফিরে পেলেন তাঁর রাজত্ব।
দেবতারাও কথা রেখেছিলেন। তাঁরা পুজো করে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের উদ্দেশ্যে ছাগ বলি দিলেন এবং সরস্বতীর উদ্দেশ্যে ভেড়া বলি দিলেন। আর যেহেতু ‘সৌত্রামণী’ যজ্ঞের স্রষ্টা সরস্বতী, তাই এই যজ্ঞের সময় ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের উদ্দেশ্যে যেমন বলিপ্রদান করার প্রথা শুরু হল, তেমনি সরস্বতীর উদ্দেশ্যে ভেড়া উৎসর্গ করার রীতিও বহাল রইল। এই ইতিহাসটিই কোথাও কোথাও এখনো ‘বাসলী’ পূজার মধ্য দিয়ে যাপিত হয়ে আসছে। কোথাও বা লোপ পেয়েছে।