বাংলার 'কর্ণ' গৌরী সেন

বেলগাছিয়া ট্রামডিপোর কাছে একটি প্রাসাদোপম বাড়ি রয়েছে। নাম "ধূর্জটি ধাম"। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাড়িটি নির্মাণ করিয়েছিলেন নারায়ণকৃষ্ণ সেন নামে এক ব্যক্তি। বাড়িটি তৈরি করেছিল মার্টিন বার্ন কোম্পানি। এই নারায়ণ কৃষ্ণ সেন হলেন গৌরী সেনের বংশধর, যাঁর নাম বাংলা প্রবাদে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

"লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন"- তাঁর নাম অহরহ ব্যবহার হয় অথচ এই গৌরী সেন সম্পর্কে প্রায় বিশেষ কিছুই জানা যায় না। মনে করা হয়, সপ্তদশ শতকে জন্ম নেওয়া গৌরী সেন ছিলেন ব্যবসায়ী নন্দরাম সেনের পুত্র। তিনি জাতিতে ছিলেন সুবর্ণ বণিক।

তাঁর জন্মস্থান নিয়েও রয়েছে নানা মুনির নানা মত। কারও মতে, তিনি হুগলী জেলার অন্তর্গত বালিগ্রামের বাসিন্দা আবার কারও মতে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে থাকতেন। তবে হুগলীতে যে "গৌরী শঙ্কর" মন্দির রয়েছে তা নাকি গৌরী সেন দ্বারা নির্মিত। তাই হুগলীর দাবিই বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। পরবর্তীকালে কলকাতার আহীরিটোলায় তিনি বসবাস করা শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। বড় হওয়ার পর পারিবারিক আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন।

জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাসের "বাঙ্গালা ভাষার অভিধান" বই থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী- 'কোম্পানীর আমলে বহরমপুর নিবাসী স্বনামধন্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। কলিকাতার আহিরিটোলায় ইহার ভদ্রাসন এখনও বিদ্যমান আছে। দেনার দায়ে যাহারা জেলে যাইত এবং অর্থাভাবে যাহাদের উদ্ধারের আর কোন উপায় থাকিত না, তাহাদিগকে গৌরী সেন নিজের টাকায় ঋণমুক্ত করিয়া দিতেন। দাতা কর্ণের ন্যায় তাঁহারও নাম প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছে'।

রেভারেন্ড লঙ সাহেব ১৮৫০ সালে "ক্যালকাটা রিভিউ" পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধে থেকে গৌরী সেন সম্পর্কে জানা যায়। সেই লেখা অনুযায়ী রাতারাতি বিপুল ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন গৌরী সেন। গৌরী সেন ছিলেন বৈষ্ণব চরণ শেঠ নামে এক ব্যবসায়ীর অংশীদার।
সেকালের অন্যতম ধনী এই ব্যক্তিটি একবার গৌরী সেনের নামে কিছু দস্তা কিনেছিলেন। পরে দেখা যায়, দস্তার সঙ্গে মিশে রয়েছে বিপুল পরিমাণে রুপো। বৈষ্ণব চরণের মনে হয় গৌরী সেনের ভাগ্যেই এই ধনলাভ। তিনি লাভের সমস্ত অংশ দিয়ে দেন গৌরী সেনকে। শোনা যায় এরফলে রাতারাতি ধনী হয়ে উঠেন তিনি।
গৌরী সেন নানাভাবে মানুষকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। ঋণগ্রস্ত কারাবন্দীদের তিনি অর্থ সাহায্য দিতেন। কোনও দরিদ্র মানুষ ভালো কাজের জন্য লড়াই করতে গিয়ে জরিমানার সম্মুখীন হলে তাদের অর্থ দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পন্য করতেন না। এছাড়াও প্রচুর দান-ধ্যান করে জলের মতো অর্থ খরচ করেছেন বলে জানা যায়। তাঁর এই দান-ধ্যান পরবর্তীকালে বাংলা প্রবাদে পরিণত হয়। তাই আজও কেউ জলের মতো টাকা খরচ করলে আমরা বলি "লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন"!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...