শিব পুরাণের জ্ঞানসংহিতার ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে বিশদে বর্ণিত আছে পার্বতীর তপস্যা ও পার্বতীর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেবের দর্শন দান ও পার্বতীর সঙ্গে বিবাহে সম্মতি দান করার বিষয়টি। আদ্যাশক্তি মহামায়া সতী দেহত্যাগের পর পর্বতরাজ হিমালয় এবং তার পত্নী মেনকার গৃহে কন্যারূপে নবজন্ম গ্রহণ করে আবার ফিরে এসেছিলেন এবং পরবর্তীতে দেবাদিদেব মহাদেবকে পুনরায় পতি হিসেবে প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তপস্যাকেই বেছে নিয়েছিলেন! কিন্তু মহাদেবকে পুনরায় প্রাপ্ত হওয়ার এই যাত্রাপথে দেবী পার্বতী যেমন কৃচ্ছ্যসাধন করেছিলেন, তেমনি মহাদেবও ছদ্মবেশে দেবীর সঙ্গে এক রসিকতা করেছিলেন, সেই গল্পই আজ বলব।
শিবপুরাণ অনুযায়ী, মহাদেবকে লাভ করা যায় একমাত্র তপস্যার ফলে তিনি রূপ সৌন্দর্যে বশীভূত হন না- এই কথা নারদের মুখ থেকে শোনা মাত্রই নিজের রূপ যৌবনকে ধিক্কার জানিয়ে মহাদেবকে পতি হিসেবে লাভ করবার জন্য তপস্যার কথা ভাবলেন দেবী পার্বতী। তপস্যায় রত হয়ে মহাদেবকে প্রীত করে তিনি মহাদেবকেই বর হিসেবে প্রার্থনা করবেন এটা তিনি মনঃস্থির করে নিলেন। কিন্তু তপস্যা করবার জন্য অবশ্যই পিতা-মাতার অনুমতি দরকার, তাই পার্বতী সখীদের তার বাবা পর্বতরাজ হিমালয়ের কাছে পাঠালেন। পিতার কুলের সম্মান বৃদ্ধি করতে মহাযোগী মহেশ্বরকে তপস্যা দ্বারা লাভ করতে চান পার্বতী তাই তিনি তপস্যার অনুমতি চেয়েছেন পিতার কাছে এই কথা শুনে পর্বতরাজ হিমালয় খুশি মনে মত দিলেন। হিমালয় সখীদের বললেন, আমার এতে কিছুমাত্র আপত্তি নেই, আমি খুশি মনেই অনুমতি দিচ্ছি তবে মেনকাও যাতে খুশি মনে তপস্যায় মত দেয় সেইমত ব্যবস্থা করো। এরপর সখীরা পর্বতরাজ হিমালয়ের অনুমতি লাভ করে মেনকার কাছে গিয়ে বললেন, মহাদেবকে পতি হিসেবে লাভ করবার জন্য তপস্যা করতে চান পার্বতী, এই বিষয়ে তিনি তার পিতার অনুমতি লাভ করেছেন আপনার অনুমতি প্রার্থনা করছেন।
মেনকা এই কথা শুনে খুশি হওয়ার পরিবর্তে দুঃখিত হলেন। তিনি পার্বতীকে তৎক্ষণাৎ তার ঘরে ডেকে এনে বললেন, কোন দুঃখে তুমি তপস্যা করতে চাইছ? অনেক তপস্যা করে তবে এই ঘরে জন্ম লাভ করছ। রাজ ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ তোমার জীবন। তোমার গৃহে কিসের অভাব আছে? তোমার পিতার ভবনে সকল তীর্থ আছে। আমাদের গৃহে সকল দেবতা আছে। অতএব তপস্যা করে তুমি কোথায় যাবে? তাছাড়া এতদিন মহাদেবের সেবা করে কী পেলে? আর তপস্যা বড় কঠিন জিনিস তোমার কোমল দেহ তপস্যার গুরুভার সহ্য করতে পারবে না সুতরাং ঘরে থেকে তপস্যা করো।
মাতার কথা শুনে তপস্যা করা থেকে বিরত রইলেন না পার্বতী, বরং নিজ সিদ্ধান্তে তিনি অটল রইলেন, তিনি বাইরে নির্জনে তপোভূমিতে গিয়ে কঠোর তপস্যা করতে চান। তার এই দৃঢ় মনোভাব বুঝে অবশেষে বাধ্য হয়ে অনুমতি দান করলেন মেনকা। পিতা মাতাকে প্রণাম করে পার্বতী তখন সখীদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। তপস্যার জন্য বস্ত্র ছেড়ে তিনি বল্কল পরলেন, হার ত্যাগ করে কন্ঠে রুদ্রাক্ষ মালা পরলেন। হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের ওপর গিয়ে একটি মনোরম স্থান বেছে তিনি তপস্যাতে রত হলেন।
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা উপেক্ষা করে পার্বতী যেভাবে তপস্যা করতে লাগলেন তেমনটা মুনি ঋষিদের পক্ষেও অসম্ভব। গ্রীষ্মকালে তিনি চারিদিকে আগুন জ্বেলে অগ্নিপরিবৃত হয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে তপস্যা করতেন। বর্ষাকালে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাটির উপর বসে তপস্যা করতেন। শীতকালে জলে দাঁড়িয়ে তপস্যা করতেন। বছরের পর বছর দিনের পর দিন তিনি এইভাবে কৃচ্ছসাধন করে তপস্যা করতে শুরু করলেন। তার তপস্যার কথা শুনে ঋষিগণ তার তপস্যা দেখতে এলেন। পার্বতী বয়সে তরুণী হলেও তার তপস্যার একাগ্রতা ও কঠোরতা দেখে সকলেই আশ্চর্য হলেন। তারা আরও দেখলেন যে পার্বতীর তপস্যার প্রভাবে বনের হিংস্র পশুরাও তাদের হিংসা ভুলে সাত্ত্বিক হয়ে গিয়েছে এবং হিমালয়ের সেই স্থানটি অত্যন্ত মনোরম হয়ে উঠেছে। পরে এই স্থানটি গৌরীশৃঙ্গ নামে বিখ্যাত হল। এই স্থান হয়ে উঠল হিমালয়ের কৈলাসের মতোই প্রসিদ্ধ ও মনোমুগ্ধকর।
পার্বতীর তপস্যা দেখে তখন দেবগণ ও ঋষিগণ মহাদেবের কাছে গেলেন মহাদেবের কাছে গিয়ে মহাদেবের স্তব করে তারা বললেন, ‘হে প্রভু আপনি শম্ভু, শঙ্কর ও বিশেষ দয়ালু বলে বিখ্যাত। এদিকে পার্বতী নিদারুণ লোক শোষণকারী অতি কঠিন তপস্যা করছেন এমন তপস্যা কেউ কখনও দেখেনি ভবিষ্যতেও কেউ দেখতে পাবে না এই তপস্যা দেব-দানবের দুর্লভ। তাই হে প্রভু আপনি আমাদের উপর প্রীত হয়ে পার্বতীর এই তপস্যার ফল দান করুন।
দেবগণ ও ঋষিগণের কথা শুনে মহাদেব বললেন দেবগণ দুষ্কর তপস্যা করে ও আমাকে দেখতে পান না তথাপি আমি পার্বতীর তপস্যায় প্রীত হয়েছি। তোমাদের অভিলাষ আমি অবশ্যই পূর্ণ করব। তোমরা নিজ নিজ ভবনে গমন করো। আমি নিজেই তোমাদের প্রিয় কার্যের অনুষ্ঠান করব। এরপর দেবগণ সেখান থেকে চলে গেলে মহাদেব এক বৃদ্ধ বামুনের বেশ ধরে পার্বতীর তপভূমিতে চলে গেলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে আসতে দেখে পার্বতীর সখীরা তাকে অভ্যার্থনা করল। তারা ফলমূল দ্বারা তাকে প্রীত করল। পার্বতী দেখলেন অতিথি ব্রাহ্মণ বার্ধক্যে বড় জর্জরিত। তিনি ঘুমের ঘোরে বারবার ঢলে পড়ছেন। তখন পার্বতী তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, “আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন?”
মহাদেব নিজের পরিচয় গোপন করে বললেন, তার নাম জটিল তারপর তিনি পার্বতীকে জিজ্ঞেস করলেন যে পার্বতী কেন এই বয়সে এমন দুষ্কর তপস্যা করছে। কী কারণে সে এমন দুষ্কর তপস্যা করেছে কেন সে বল্কল ও মৃগ চর্ম ধারণ করে তার যৌবনের সৌন্দর্য ম্লান করছে। এই নবীন বয়সে সে যখন এত কঠোর তপস্যা করছে তখন সে নিশ্চয়ই এর ফল পাবে। পার্বতী এবার নিজে কিছু না বলে বৃদ্ধের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সখীদের ইঙ্গিত করলেন।
সখিরা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে বললেন," হে ব্রাহ্মণ আমাদের সখী পার্বতী ইন্দ্রাদিদেবগণকে ত্যাগ করে পিনাকপানি মহাদেবকে পতি রূপে লাভ করবার জন্য এত কঠোর তপস্যা করছেন। তিনি যখন তপস্যা শুরু করেন তখন কতগুলি বৃক্ষরোপণ করেছিলেন সেই বৃক্ষগুলি আজ ফল দান করছে কিন্তু আমাদের সখীর কামনা আজও ফলবতী হয়নি। তার উদ্দেশ্য আজও পূর্ণ হয়নি। মহাদেব তার নেত্রানলে ভস্মিভূত করেছেন কামদেবকে, তিনি কোন রূপ সৌন্দর্যে বশীভূত হবার নন, তাই দেবর্ষি নারদের পরামর্শে আমাদের সখী এই কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছেন। এই আমরা সখীর পক্ষ থেকে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলাম।"
এরপর জটিল নামের সেই ব্রাহ্মণ সখীদের কথা শুনে বললেন তোমাদের সখীর এইসব কথা সত্য না পরিহাস তোমাদের সখী তার মনের কথা নিজ মুখে বলছেন না কেন? তখন পার্বতী নিজেই বললেন, এইসব কথাই সত্য-মিথ্যা নয়। আমি মন ও বাক্য দ্বারা সত্য সত্যই সেই শঙ্করকেই পতি রূপে বরণ করছি। আমি তাকে দুর্লভ বস্তু বলেই জানি, জানি তাকে সহজে পাওয়া যাবে না। তাই তার জন্য এই কঠোর তপস্যার অনুষ্ঠান করেছি। পার্বতীর এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ বেশী শিব নীরবে চলে যেতে থাকলেন। পার্বতী দেবী তখন জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এত শীঘ্র চলে যাচ্ছেন? পার্বতীর কথা শুনে দণ্ডধারী ব্রাহ্মণ বললেন, "হে দেবী তুমি প্রথমে আমার শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হয়েছিলে, কিন্তু এখন তোমার কথা শুনে তোমার প্রতি আমার সেই শ্রদ্ধার ভাব আর নেই। এখন আমি মিত্রভাবে যা বলছি শোনো আমার এই ভাবের বৈপরীত্য তুমি করেছ। কারণ দেখছি তুমি স্বর্ণ ত্যাগ করে কাষ্ঠখণ্ড গ্রহণ করেছ। তুমি চন্দন ত্যাগ করে কদর্ম লাভ করবার ইচ্ছা করছো তুমি হস্তি করে বলদ গ্রহণ করতে চেয়েছ তুমি গঙ্গাজল ত্যাগ করে সামান্য কূপের জল পান করতে চাইছ। তুমি সূর্যের আলো পরিহার করে জোনাকির আলো ও চীনাংশুক ত্যাগ করে চর্ম বস্ত্র গ্রহণ করেছ।তুমি গৃহবাস ত্যাগ করে বনবাস এবং দেবগনের সঙ্গ ত্যাগ করে অসুরগণের সহবাসের মতো তুমি অযৌক্তিক কার্য করছ। কারণ ইন্দ্রাদি দেবগণের পরিবর্তে অনার্য দেবতা মহাদেবের প্রতি অনুরক্ত হয়েছ। লোকসমাজে তোমার এই কার্য কোনও মতেই যুক্তিযুক্ত নয়, বরং এটা লোকও বিরুদ্ধে কাজ। এরপর পার্বতীর সামনে বৃদ্ধ বেশী মহাদেব নিজের নাম নিয়েই নানান নিন্দা করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, মহাদেব অনার্য। তার জন্ম বংশ পরিচয় কিছুই নেই। তার গোটা গায়ে ছাই ভস্মমাখা। তার কন্ঠ বিষে পরিপূর্ণ। সে বিদ্যা, জ্ঞান, দেশাচার কিছুই জানে না। তোমার রূপ গুণ মহাদেবের রূপগণের সম্পূর্ণ বিরোধী।”
বারংবার এই ভাবে মহাদেবের নামে নিন্দার কথা শুনে পার্বতী যখন অতিমাত্রায় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন তখন তিনি শিব নিন্দাকারী ব্রাহ্মণকে বললেন, “ তোমার এইসব কথা শুনে বুঝলাম তুমি শিবের বিষয়ে কিছুই জানো না। তুমি যে বলছ আমি সেই দেবকে জানি, এ কথা মিথ্যা ভিন্ন আর কিছুই নয়।”
পার্বতী আরও বললেন, ‘যে সদাশিব সর্বদাই মঙ্গলময় তার চাইতে অধিক মঙ্গলের আর কী হতে পারে? তিনি নিজেই প্রীতিপূর্বক বিষ্ণুকে সর্ববেদ দান করেছিলেন সেই পরম আত্মার আবার বিদ্যার প্রয়োজন কী? তিনি সকলের আদি তার আবার বংশ পরিচয়ের প্রয়োজন কী?’ এইভাবে পার্বতী সেই ব্রাহ্মণবেশী শিবের নিকট শিবের মহিমা তত্ত্ব প্রকাশ করে শেষে বললেন, তিনি আমার একমাত্র অভিষ্ঠ। তুমি বলছো তুমি শিবকে জানো তবে আমার বিবেচনায় তুমি তাকে কিছুই জানো না। তিনি আমার সর্বাপেক্ষা অভিলাষিত। এই বলে পার্বতী যখন সেখান থেকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন তখন বৃদ্ধ ছদ্মবেশ ত্যাগ করে নিজ রূপ ধারণ করলেন।
মহাদেব স্বরূপে পার্বতীর সামনে আবির্ভূত হয়ে বললেন, “ আমাকে পরিত্যাগ করে তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমি কিন্তু তোমাকে পরিত্যাগ করবো না। আমি তোমার তপস্যায় প্রীত ও প্রসন্ন হয়েছি। এখন বর প্রার্থনা করো তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নেই। তুমি আমার গৃহে চলো। লজ্জা পরিত্যাগ করো।” মহাদেবের কথা শুনে পার্বতী তার এত দিনের সমস্ত দুঃখ ভুলে গেলেন, মহাদেবের যে রূপ তিনি এতকাল তপস্যা করেছেন,সেই রূপ নিজের চোখের সামনে দেখে তিনি লজ্জিত হলেন আবার মহাদেবের মুখে তপস্যায় প্রীত হওয়ার কথা শুনে তিনি বুঝলেন তাল কঠোর তপস্যার এইবার ফলপ্রাপ্তি হল।
তিনি তখন সখীদের দিয়ে মহাদেবকে বলা করালেন, “ হে দেবেশ আপনি যদি আমার উপর প্রসন্ন হয়ে থাকেন তাহলে আমি যে রূপ বলছি তাই করুন। সংসারে প্রসিদ্ধ পুরুষেরা যে রীতিতে শুভ বিবাহ করে থাকেন সেই রীতিতে আপনি আমাকে বিবাহ করুন তাতে আমার পিতা পর্বত হিমালয় সুখী হবেন তাতে আপনার গৌরব বাড়বে।" পার্বতীর কথা শুনে মহাদেব বললেন, “তোমার যা ইচ্ছা তাই হোক।”
পার্বতী তখন শিবের আজ্ঞা নিয়ে হিমালয় গমন করলেন। বহু বছর পর পার্বতীকে দেখে পার্বতীর পিতা-মাতা যেমন সন্তুষ্ট হলেন তেমনি পার্বতীর তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করেছেন শুনে তারা জয় জয় করতে লাগলেন। পার্বতীর মুখ থেকে তপস্যা ও তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেবের দর্শন দেওয়ার সব কথা শুনে পর্বতরাজ হিমালয় সাধু সাধু বলে নারদের প্রশংসা করতে লাগলেন। তিনি আবেগের সঙ্গে বললেন," আজ আমার গৃহাশ্রম সার্থক হল। কু পুত্র অপেক্ষা সুকন্যা শ্রেষ্ঠ। এ কন্যা কুলের গৌরবকারিণী।"-