রাজা থেকে শুরু করে সন্ন্যাসী, সবাই জড়িয়েছেন ইলিশের জালে! তাঁদের মধ্যেই অন্যতম স্বামী বিবেকানন্দ। জীবন জুড়ে ধর্মের সাধনা করলেও, খাবার পাতে কিন্তু ধর্মকে জড়াতে নারাজ ছিলেন স্বামীজি। তাই শেষ মধ্যাহ্নভোজেও তাঁর পাতে বাদ পরেনি ইলিশের ঝোল-অম্বল-ভাজা। প্রাচীন শ্লোকে বলা আছে, ইলিশ মাছ নাকি নিরামিষ। কিন্তু এসব নিয়ে স্বামীজী কিছুই ভাবতেন না। তাই ইলিশ পেলে দুনিয়া ভুলে যেতেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী।
বিবেকানন্দের জীবনী থেকেই এক ঘটনা জানা যায়, একবার স্টিমারে চড়ে গোয়ালন্দে গিয়েছিলেন স্বামীজি। পথে যেতে যেতে একটা নৌকার দিকে চোখ গেল। জেলেদের জাল ভর্তি রূপালী ইলিশ। আর তা দেখে রীতিমতো উত্তেজিত স্বামী বিবেকানন্দ। সঙ্গী কানাইকে নির্দেশ দিলেন, টাটকা ইলিশ কিনে আনতে। কানাইয়ের মত, দলে রয়েছেন মোট সাতজন তাই তিনটি বা চারটি ইলিশ কিনলেই সকলের হয়ে যাবে। সেই শুনে স্বামীজি ধমক দিয়ে বললেন, আমরা খাবো আর স্টিমারের খালাসি-মাঝিমাল্লারা চেয়ে দেখবেন? তারপর সেদিন শেষ পর্যন্ত কেনা হয়েছিল ষোলোটি ইলিশ। এক একটি মাছ চার পয়সা করে, তাই মোট দাম পড়েছিল এক টাকা। এবার স্বামীজির আর এক ইচ্ছে, “পুঁইশাক হলে বেশ হত, সঙ্গে গরম ভাত”। স্টিমার এক গ্রামের পাশে দাঁড় করিয়ে এক গ্রামবাসীর বাগান থেকে আনা হল পুঁইশাক। আর ইলিশের মুড়ো দিয়ে সেই শাক খেয়ে খুশি হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ফেরার পথে দীক্ষা দিয়ে গেলেন পুঁইশাকের মালিককে।
ইলিশের প্রতি সবসময় এমন টান ছিল স্বামীজীর। ১৯০১ সালের ৬ জুলাই বেলুড় মঠে বসেই ক্রিস্টিনকে চিঠিতে সে কথা লিখেছিলেন বিবেকানন্দ। তিনি লিখেছিলেন, “নদীতে ইলিশ উঠেছে। লিখছি আর দেখছি। ঘরের গায়ে ঢেউ ধাক্কা খেয়ে উছলে উঠছে। নিচে শত শত মাছ ধরার নৌকা সবাই ধরায় ব্যস্ত।” সঙ্গে ইলিশের প্রচুর প্রশংসা করে বিদেশিনি শিষ্যাকে এটাও লিখেছিলেন যে “পৃথিবীতে এমন জিনিসটি হয় না। “
ঠিক তার পরের বছর। সেদিন ১৯০২ সালের ৪ জুলাই মঠে কেনা হয়েছিল সে বছরের প্রথম ইলিশ। তার দাম নিয়ে খুনসুটি করেছেন স্বামীজি। প্রমাণ মাপের ইলিশ দেখে পূর্ববঙ্গীয় শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে ডেকে বলেছেন, ‘তোরা নূতন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কী দিয়ে পূজা করতে হয় কর।’ স্বামী প্রেমানন্দ লিখেছেন, ‘…আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল, ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন।’ তৃপ্তি ভরে খেয়ে তিনি আবার মজা করে বললেন, ‘একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে।’
সেই দিনই শেষবারের মতো মধ্যাহ্নভোজন করেছিলেন স্বামীজি। পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার দিনেও তিনি জড়িয়েছিলেন ইলিশ মাছের স্বাদে।