এই অধুনা-অবহেলিত দক্ষিণ দিনাজপুর নিয়ে কতই না কিংবদন্তী, লোকগাথা বা ঐতিহাসিক কাহিনী রয়েছে। পুরাকালে নাকি এই অঞ্চল পরশুরাম দ্বারা শাসিত ছিল। হ্যাঁ, ইনি সেই মহাভারতের পরশুরাম যাকে স্বয়ং ভগবান মহাদেব পরশু বা কুঠার দিয়েছিলেন অস্ত্র স্বরূপ যা দিয়ে তিনি একুশবার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন। এই পরশুরামই বিষ্ণুর অবতার বলে কথিত।
এই অঞ্চলেই নাকি শ্রীরামচন্দ্র প্রজাদের কথায় সীতাকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকি মুনির আশ্রম ছিল দক্ষিণ দিনাজপুরের করতোয়া নদীর তীরে। এই নদীতে স্নান করে এর জল দিয়েই তিনি তাঁর পূজা-অর্চ্চনার কাজ করতেন। যে জলাশয়ের ঘাটে তিনি তাঁর ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করতেন সেই ঘাটটি তর্পণ ঘাট নামে পরিচিত ছিল। এই জলাশয়টিই বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন দিঘি নামে পরিচিত।
এই বাল্মিকী মুনির কাছেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সীতা। এই তপন দিঘির কাছেই রয়েছে সীতাকুণ্ড এবং সীতাকোট নামের একটি জায়গা যেখানে সীতা বসবাস করতেন এবং স্নানাদি করতেন।
এর আগের পর্বে লিখেছিলাম যে এই জেলার বৈরাট্টা অঞ্চলে মহাভারতখ্যাত বিরাট রাজার গোশালা ছিল। এই জেলারই ঘোড়াঘাট অঞ্চলে মহারাজ বিরাটের অশ্বশালা ছিল। করতোয়া নদীর জলেই সেই ঘোড়াদের স্নান করানো হতো। সেই জায়গার নাম ছিল "বাজিঘট্ট"। মহাভারত অনুযায়ী বিরাট রাজার শ্যালক কীচক শ্রীমতী নদীর পাড়ে দেহাবন্দে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন এবং জনবসতি গড়ে তুলেছিলেন।
এই দেহাবন্দ দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর মহকুমার কুশমণ্ডিতে অবস্থিত। মহাভারতের কাহিনী অনুসারে অজ্ঞাতবাসের সময় মহারাজ বিরাটের রানী সুদেষ্ণার পরিচারিকা বা সৈরিন্ধ্রী রূপে স্বয়ং দ্রৌপদী ছদ্মবেশে বিরাটের প্রাসাদে বাস করতেন। সেই সময় কীচক তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করলে ভীম এসে কীচককে এবং তার সহচরদের বধ করেন। তাদের দাহকার্যও বৈরাট্টা গ্ৰামেই এক জলাশয়ের ধারে সম্পন্ন হয়। ঐ জলাশয়ের নাম এখনো কীচককুণ্ড রয়ে গেছে।
কথিত আছে যে এই বৈরাট্টাতেই দুর্যোধন তাঁর সৈন্য বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন বিরাটের গোশালা লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে। তখন বৃহন্নলার ছদ্মবেশে অর্জুন বিরাটরাজের পুত্র উত্তরের রথের সারথি হয়ে শমীবৃক্ষ থেকে তাঁদের অস্ত্র নামিয়ে নিয়ে কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই যুদ্ধে কৌরবদের হেরে পালাতে হয়েছিল।
মহাভারতে উল্লিখিত রয়েছে যে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় দুর্যোধন-মাতুল শকুনি গুপ্তচর রূপে প্রাচী রাজ্যের বিবরণ দিচ্ছেন। এই দক্ষিণ দিনাজপুরের ভৌগলিক অবস্থানের সঙ্গে সেই প্রাচী রাজ্যের সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদদের মতে এই দক্ষিণ দিনাজপুর অঞ্চলই প্রাচীন পুন্ড্রদেশের অন্তর্গত ছিল যে পুন্ণ্ড্রদেশ বা পুণ্ড্রবর্ধন বাংলার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান নগর ছিল। পুণ্ড্রদেশের দুটি প্রধান নগরী ছিল- গৌড়নগর এবং কোটিবর্ষ।
এই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রাচীন কোটিবর্ষেরই অংশ ছিল। এই এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া প্রাচীন মৌর্যযুগের মুদ্রা থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে এই কথা। পঞ্চম শতক থেকে শুরু করে পাল সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত পাঁচশ বছর এই কোটিবর্ষের গৌরব এবং মর্যাদা অক্ষুন্ন ছিল। বিখ্যাত জৈন পণ্ডিত ভদ্রবাহু এই কোটিবর্ষের অধিবাসী ছিলেন। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর ছিল তাঁর জন্মস্থান। জৈন ধর্মের প্রচার করার জন্য এখানে এসেছিলেন মহাবীরের শিষ্য জম্বুস্বামী এবং এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
তাহলে পাঠকবন্ধুরা, দেখছেন তো আমাদের এই বাংলায় কত প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান যে রয়েছে আমরা হয়তো জানিও না যেসব জায়গা নীরবে বহন করে নিয়ে চলেছে এই বঙ্গের গৌরবময় ঐতিহ্য এবং ইতিহাস। আজ এই পর্যন্ত থাক বন্ধু। পরের সপ্তাহে আবার নতুন কথা ও কাহিনী নিয়ে আসব।