গত তিন সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছি। আজ এই জেলার মানুষদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, পেশা, রাজনৈতিক সচেতনতা, জেলার পর্যটন, বিখ্যাত খাবার, ইত্যাদি নিয়ে একটু আলোচনা করি...
ব্রিটিশ-শাসনের সময় প্রাণ দিয়ে লড়াই করেছিলেন অধুনা-দক্ষিণ দিনাজপুর অঞ্চলের মানুষজন। এলাকাকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত করতে তাঁদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। দুই দিনাজপুরের মানুষই স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু তারপরও যখন তারা দেশভাগ আটকাতে পারেন নি তখন দেশভাগের যন্ত্রণাকে বুকে করে প্রচুর মানুষ ওপার-বাংলা থেকে এপার-বাংলায় এসে বসতি তৈরি করেছিলেন আজকের দক্ষিণ দিনাজপুর অঞ্চলে। এই জেলার বিশেষ করে সদর শহর বালুরঘাটের মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা আছে। ব্রিটিশদের অপশাসনের/ অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে তেভাগা আন্দোলন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাতেই শুরু হয়েছিল প্রথম।
শিক্ষার দিক দিয়েও দক্ষিণ দিনাজপুর অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছে অন্যান্য জেলার তুলনায়। সাক্ষরতার হারে এই জেলা অগ্রগণ্য। যদিও এই রাজ্যের দরিদ্র জেলাগুলোর মধ্যে এই জেলার নাম রয়েই গেছে। আসলে এই জেলার আশি শতাংশ মানুষ ছিলেন কৃষি নির্ভর।
দেশভাগের পর ছিন্নমূল মানুষজনের এই জেলায় বসতি স্থাপন করতেই বহু সময় লেগে গিয়েছিল। আর যেহেতু এই জেলার মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী বয়ে গিয়েছে এবং অনেকগুলি বিশাল দীঘি রয়েছে তাই বহুদিন পর্যন্ত এই জেলার মানুষ জীবিকা হিসেবে কৃষিকাজকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই জেলার ব্লকে ব্লকে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র এবং কলেজ স্থাপিত হওয়ায় বর্তমানে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে শিক্ষা নির্ভর পেশাজীবী যেমন শিক্ষক, অধ্যাপক, চাকরিজীবী মানুষের সংখ্যা।
আর মেধাবী ছাত্র ছাত্রী যে এই জেলায় কম নেই বরং তথাকথিত উন্নত জেলাগুলোর থেকে বেশি সেটা উচ্চমাধ্যমিক বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই জেলার স্কুলগুলির ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়। বিশেষত বালুরঘাট হাই স্কুলের রেজাল্টের তালিকায় তো প্রত্যেক বছরই মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম কুড়ি জনের মধ্যে থাকা বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর নাম থাকে।
সংস্কৃতি চর্চা বিশেষ করে সঙ্গীত এবং নাট্যচর্চার দিক থেকে ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা বেশ এগিয়ে চলেছে। ওপার বাংলা থেকে সর্বহারা হয়ে যারা এই দেশে চলে এসেছিলেন তাঁদের কাছে নাট্যচর্চা ছাড়াও সঙ্গীতচর্চা
ছিল দুঃখ ভোলার অন্যতম মাধ্যম। এখন বেসরকারি টিভি’র জনপ্রিয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতার দৌলতে মানুষ চিনে গিয়েছেন এই জেলাকে। কত প্রতিভাবান প্রতিযোগী এই জেলা থেকে গিয়ে সব সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন, সফল হচ্ছেন এবং তাদের জেলার নাম উজ্জ্বল করছেন।
দক্ষিণ দিনাজপুরে কোন পাহাড় নেই। তবে অনেকগুলো ছোট বড় ঢিপি রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি খনন করে পাওয়া গিয়েছে বহু প্রাচীন মুদ্রা, প্রাচীন বাংলার মানুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং এই সব জিনিসের থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা যে একটি ঐতিহাসিক স্থান তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এখনও এই খনন কার্য চলছে ভারত সরকারের আর্কিওলজিক্যাল বিভাগের দায়িত্বে।
এই জেলায় কোন জঙ্গল নেই তবে বর্তমানে সংরক্ষিত বনাঞ্চল তৈরি করা হয়েছে। হিন্দুপ্রধান জেলা হলেও এখানে বহু মুসলমান মানুষ বসবাস করেন এবং যথেষ্ট পরিমাণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে চলেন এই জেলার অধিবাসীরা। দুই ধর্মের মানুষই নিজের নিজের ধর্মীয় উৎসব পালন করেন পরস্পরের সহযোগিতায়, বেশ ধুমধাম সহযোগে।
প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এখানে তাই সবুজের সমারোহ প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে অপরূপ সাজে। অনেকগুলি দীঘি রয়েছে এই জেলায়। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল তপন দীঘি এবং মহীপাল দীঘি। এই মহীপাল দীঘি পালবংশের শাসনকালে খনন করা হয়েছিল। ইতিহাস প্রসিদ্ধ বানগড় এই জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। গুপ্ত যুগের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে এখানে। খাঁ/খান গান এই জেলার বিশেষ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দক্ষিণ দিনাজপুরের গমীরা মুখোশ ও বিখ্যাত।
এবার একটু খাবার দাবারের গল্পে আসা যাক। প্রচুর নদী, দীঘি ও জলাশয় থাকার কারণে মাছ পাওয়া যায় অনেক রকম। সুগন্ধি চাল যেমন তুলাইপাঞ্জি, কালো নুনিয়া এবং কাটারিভোগ চালের সুখ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আর অতি বিখ্যাত হল গঙ্গারামপুরের ক্ষীর দই। এমন সুস্বাদু মিষ্টি দই পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
অতএব পাঠক বন্ধুগণ, এই ঐতিহাসিক জেলাটিকে দেখার জন্য এবং সুবিখ্যাত ক্ষীর দইয়ের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য আমাদের যেতেই হবে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায়। দক্ষিণ দিনাজপুর বৃত্তান্ত এবারের মতো শেষ করি। পরের সপ্তাহে নতুন জেলায় যাওয়া যাবে কেমন?