দক্ষিণ দিনাজপুর... এই জেলাটি সত্যি বলতে একটু অবহেলিতই। অথচ ঐতিহাসিক স্থানের এক গুরুত্বপূর্ণ নজির হল এই জেলা। বহু মিথ বা পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা নিয়ে। সেরকম কয়েকটি কাহিনী বা কিংবদন্তি শোনাই আপনাদের। পাঠকবন্ধু, তাহলে বসে পড়ুন গল্প শোনার জন্য...
এই যে আমাদের দক্ষিন দিনাজপুর জেলা, যা কিনা পুরো দিনাজপুর জেলাকে কাটাছেঁড়া করে তৈরি করা হয়েছিল সেই দিনাজপুরের উল্লেখ কিন্তু মহাভারতেও আছে। ভাবা যায়! মহাভারতের কাহিনী অনুযায়ী রাজা বলির পুত্র পুণ্ড্র উত্তরাধিকার সূত্রে এই দিনাজপুর অঞ্চলের অধীশ্বর হয়েছিলেন এবং এই অঞ্চল পুণ্ড্রদেশ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে "প্রাচীন কালে ইহা একটি প্রসিদ্ধ নগরী ছিল। ...মৌর্য যুগের একখানি শিলালিপিতে এই স্থানটি 'পুণ্ড্রনগরী' বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে"।
মহাভারতের বিরাট রাজার সঙ্গেও এই দক্ষিণ দিনাজপুরের নানা কাহিনী জড়িত রয়েছে। কিংবদন্তি অনুযায়ী দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর এলাকার বৈরাট্টা অঞ্চলে বিরাট রাজার গোশালা ও রাজপ্রাসাদ ছিল। এই বিরাট রাজ্যেই পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাসের সময় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে বিরাট রাজার কন্যা উত্তরার সঙ্গে অর্জুন পুত্র অভিমণ্যুর বিবাহ হয়েছিল।
এই বৈরাট্টাতেই একটি শমীবৃক্ষের কোটরে নাকি পাণ্ডবেরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন। বিরাট রাজার অসংখ্য গরু ছিল এবং এই গরুদের জলপানের জন্য বিশাল বিশাল দীঘি খনন করিয়েছিলেন তিনি। গৌড়দীঘি, আলতাদীঘি, মালিয়ানদীঘি ইত্যাদি বিরাট বিরাট জলাশয়গুলি দক্ষিণ দিনাজপুরে এখনো রয়েছে। রাজার রানী এবং রাজকন্যাদের স্নানের জন্য তৈরি করা হয়েছিল হাতিডোবার ঘাট।
মিথ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্র দুর্মতি কংসের মাথা ছিন্ন করে দিয়েছিল। কংসের মুণ্ডটি পড়েছিল কুশমণ্ডি থানার করঞ্জি গ্ৰামে। ঐ এলাকার উঁচু ঢিপি ও ভাঙা স্তূপ এখনো নাকি সেই ছিন্ন মাথার চিহ্ন বহন করেছে। প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় এখানে কংসব্রত বা কাসব উৎসব পালন করা হয়।
পৌরাণিক যুগে রাজা বাণ এই অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। তাঁর নাম অনুসারে এই রাজ্যের নাম ছিল বাণরাজ্য এবং রাজধানীর নাম হয় বাণনগর। এই বাণনগর হলো বর্তমান দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর থানার অধীনস্থ গ্ৰাম বাণগড়। এর পাশেই রয়েছে ব্রাহ্মণী এবং পুনর্ভবা নদী। পুনর্ভবা নদীর তীরে নাকি বাণরাজার কন্যা ঊষার ঘর ছিল যার নাম ছিল ঊষাতিটি। দক্ষিণ দিনাজপুরের নারায়ণপুর গ্ৰামের একটা মস্ত ঢিপিকে এখনো স্থানীয়
মানুষজন "ঊষাতিটি" বলে থাকেন।
কথিত আছে যে শ্রীকৃষ্ণ পৌত্র অনিরুদ্ধ এই বাণরাজ্যে বেড়াতে এলে বাণকন্যা ঊষা তাঁর প্রেমে পড়েন এবং পিতা-মাতার অগোচরে তিনি অনিরুদ্ধকে বিবাহ করেন। রাজা বাণ জানতে পেরে খুব রেগে গিয়ে অনিরুদ্ধকে কারাবন্দী করে রাখেন। তখন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নাতিকে উদ্ধার করার জন্য বাণরাজ্যে আসেন এবং বাণরাজ ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়।
যুদ্ধে বাণ পরাজিত হন। রাজা বাণের নাকি এক হাজারটি হাত ছিল। শ্রীকৃষ্ণ তারমধ্যে দুটি হাত মাত্র রেখে বাকি ৯৯৮টি হাত কেটে দাহ করেছিলেন। পুনর্ভবা নদীর তীরে যেখানে শ্রীকৃষ্ণ এই দাহকার্য করেছিলেন সেই জায়গার নাম করদহ যা এখনকার দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত।
আজ এই পর্যন্তই থাক। পাঠকবন্ধুগণ, একটু অপেক্ষা করুন। আরো ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে পরের সপ্তাহের জেলাকাহন নিয়ে আসব।