বঙ্গভূমির জেলায় জেলায় ঘুরতে ঘুরতে এবার এলাম দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায়। মালদহ বা মালদা জেলা থেকে আরো উত্তরদিকে যেতে হলে কিন্তু এই জেলাটাই প্রথম পড়বে। তাই মালদায় বেড়িয়ে, রসকদম্বের আর আমের স্বাদে "প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে" চলুন এবার উত্তরমুখী হওয়া যাক।
আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন, যাচ্ছি উত্তর দিকে অথচ জেলার নাম "দক্ষিণ দিনাজপুর"... বেশ মজার না! কিন্তু উত্তরের জেলার নাম কীভাবে দক্ষিণ দিয়ে শুরু হল সেটাই আপনাদের এখন জানাব হে পাঠকবন্ধুগণ। প্রথমেই দিনাজপুর নামের ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
জনশ্রুতি আছে অবিভক্ত বাংলায় দিনাজ নামের এক রাজা দিনাজপুর রাজপরিবারের এবং রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারেই সেই এলাকার নাম হয় দিনাজপুর, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা যখন শাসনভার গ্রহণ করে তখন সেই রাজার সম্মানে পুরো জেলার নামকরণ করে দিনাজপুর।
তবে এই প্রসঙ্গে কিছু ঐতিহাসিক গবেষক অন্য মতও পোষণ করে থাকেন। তাঁদের মতে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই দিনাজপুর অঞ্চলের ভাতুরিয়ার জমিদার ছিলেন রাজা গণেশ। বাংলায় সুলতানি আমলে ইলিয়াস বংশের অবসান ঘটলে তিনিই হন গৌড়ের তথা বাংলার রাজা এবং তিনিই রাজবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন।
সুলতানি আমলে একমাত্র হিন্দু রাজা হওয়ায় তিনি প্রজাদের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন এবং সিংহাসনে আরোহণের পর "দনুজমর্দনদেব" উপাধি গ্ৰহণ করে বেশ কয়েক বছর রাজত্ব করেছিলেন। এই "দনুজ" শব্দটির থেকেই "দিনাজ" বা দিনাজপুর নামটির উৎপত্তি হয়েছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদদের একাংশ। যেটাই হোক, দিনাজপুরের ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো।
তারপর এলো সেই অভিশপ্ত ১৯৪৭। আমাদের দেশ টুকরো টুকরো করে ভাগ করে দিল ইংরেজরা। দেশভাগের পর দিনাজপুর জেলার পশ্চিমাংশ পশ্চিম দিনাজপুর নামে পশ্চিবঙ্গে যুক্ত হল। ১৯৯২ সালে যোগাযোগ এবং শাসনকার্য জনিত সুবিধার জন্য পশ্চিম দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা গঠিত হয়৷ এবার বুঝলেন তো বন্ধুরা উত্তরে কীভাবে দক্ষিণ চলে এল।
এইখানে একটুখানি ব্যক্তিগত তথ্য জানাই? এই দিনাজপুর নামটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই নিবন্ধ লিখিয়ের অনেকটা সেন্টিমেন্ট বা আবেগ। অবিভক্ত বাংলায় দিনাজপুর হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার ঠাকুরদাদা। তিনি সপরিবারে বসবাস করতেন দিনাজপুর শহরে। আমার বাবাও সেই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন শৈশবে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর সেই স্কুল চলে যায় বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে।
সেই সময়ও কিন্তু আমার পরিবারের সদস্যরা পশ্চিমবঙ্গে আসেন নি, তাঁরা পূর্ব বঙ্গেই ছিলেন। ১৯৪৯ সালে আমার কাকার অসুস্থতার কারণে আমার ঠাকুরদা ঠাকুরমা কলকাতায় নিয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য। সঙ্গে আরো তিনটি শিশু। আর ফিরে যেতে পারেন নি। দিনাজপুরে আমাদের বাড়িতে, বাগানে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আজও আমার সেই "দেশের বাড়ির" কথা বলতে গেলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আবার জেলা কথায় ফিরি।
১৯৯২ সালের ১ এপ্রিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাটি গঠিত হয়। এই জেলার ৮ টি থানা এবং দুটি মহকুমা রয়েছে। প্রথমটি হল বালুরঘাট সদর মহকুমা আর অপরটি গঙ্গারামপুর মহকুমা। এটি পুরানো পলিমাটির দ্বারা তৈরী বরেন্দ্র ভূমির বিস্তৃতাংশ। এই জেলায় যে নদীগুলো বইছে তাদের নাম হল আত্রাই, টাঙ্গন এবং পুনর্ভবা। এই নদীগুলিই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাকে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা করে রেখেছে।
আজ এই পর্যন্তই থাক। পরের পর্বে আরো ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব আমরা।