এবার চলুন সোজা বেরিয়ে পড়ি... মুর্শিদাবাদ ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে না? মুর্শিদাবাদ জেলায় যতগুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে সম্ভবত ততগুলো আর পশ্চিমবঙ্গের কোনো জেলায় নেই। শিল্প এবং স্থাপত্য কীর্তির অতুলনীয় সমাবেশ ঘটেছে মুর্শিদাবাদে।
প্রথমেই যে জায়গাটার কথা মনে পড়বে আমার মুর্শিদাবাদে এলেই - কী ভাবছেন পাঠক - হাজারদুয়ারি? না, সেই জায়গাটির নাম হল খোশবাগ। হ্যাঁ পাঠকবন্ধুরা, মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গেলে সবার প্রথম খোশবাগে যাবো কারণ এইখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন নবাব আলিবর্দী খাঁ এবং তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় দৌহিত্র বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। খোশবাগে আলিবর্দী খাঁর পরিবারের প্রায় সকলেরই সমাধি রয়েছে। নরম গালিচার মতো ঘাসে ঢাকা এই বাগিচায় বড় বড়ো গাছ দাঁড়িয়ে আছে বহু প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। সিরাজের সঙ্গেই চির ঘুমে শায়িত রয়েছেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী। শান্ত, প্রায় নিস্তব্ধ এই সমাধিস্থলে এলে আপনার আবার মনে পড়ে যাবে সেই বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস এবং সিরাজের করুণ পরিণতির কথা মনে এলে আপনার চোখে জল আসবেই।
খোশবাগের ভিতরে একটি মসজিদও রয়েছে যেখানে দিনের শেষে নামাজ পড়তেন আলিবর্দী ও তাঁর পরিবারবর্গ।
হ্যাঁ, খোশবাগে যেতে হলে আপনাকে বহরমপুর গিয়ে ভাগিরথী পার হয়ে যেতে হবে। সে আপনি নৌকায় করেও যেতে পারেন অথবা গাড়ি নিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে ও যেতে পারেন। বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই ঐতিহাসিক স্থানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে।
এবারে হাজারদুয়ারী যাওয়ার আগে অল্প সময়ের জন্য দেখে নিন মতিঝিল। ঘোড়ার খুরের আকৃতির মতিঝিল একদা বিখ্যাত ছিল মুক্তো চাষের জন্য। ১৭৫০-৫১ সালে এই মতিঝিল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন আলিবর্দী খাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা ঘসেটি বেগমের স্বামী নবাব নওয়াজেস মহম্মদ খাঁ। একসময় এখানে বাস করতেন ঘসেটি বেগম যিনি সম্পর্কে সিরাজউদ্দৌলার মাসি হলেও মীরজাফরদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। কথিত আছে যে এই মোতিঝিল প্রাসাদেই সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের নকশা তৈরি করা হয়েছিলো। মতিঝিল অবশ্য পরে সিরাজ অধিগ্রহণ করেছিলেন। নিজের বসবাসের করার জন্য অবশ্য বানিয়ে ছিলেন হিরাঝিল প্রাসাদ যে প্রাসাদ চূড়ান্ত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। মতিঝিল প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়ে গেছে কিন্তু হিরাঝিল ভাগীরথীর গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে।
এবার চলুন হাজারদুয়ারি প্রাসাদে। হাজারদুয়ারি প্রাসাদ কিন্তু সিরাজউদৌল্লা বা মুর্শিদকুলি খাঁ এই দুজনের কারোরই তৈরী নয়। একচল্লিশ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন নবাব নাজিম হুমায়ূন জাহ। ১৮২৯ শহরে এই প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এই প্রাসাদের রূপকার ছিলেন এক ইউরোপিয়ান ইঞ্জিনিয়ার ডানকান ম্যাকলিওড। এই প্রাসাদের স্থাপত্যশৈলী ইউরোপীয় ধাঁচের। হাজারদুয়ারি অর্থাৎ এক হাজার দরজা বিশিষ্ট প্রাসাদ। এর মধ্যে ৯০০টি দরজা আসল এবং ১০০টি নকল। অবশ্য নকল দরজাগুলো সহজে চিহ্নিত করা যায় না সেগুলি এমনভাবেই দেওয়ালের মধ্যে ডিজাইন করে তৈরি করা হয়েছে। শত্রুরা হঠাৎ আক্রমণ করলে তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এইভাবে প্রাসাদের দরজা এবং দেওয়ালের নক্সা করা হয়েছিল। ১১৪টি ঘর ও ৮টি গ্যালারি বিশিষ্ট এই প্রাসাদ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৮৩৭ সালে। সাধারণ ভাবে এই প্রাসাদ হাজারদুয়ারি প্রাসাদ নামে পরিচিত হলেও নবাব হুমায়ুন জাহ একে "বড়কুঠি" বলতেন।
হাজারদুয়ারী প্রাসাদের ভিতরে একটি সংগ্ৰহশালা বা মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে যার
রক্ষণাবেক্ষণ বা তত্ত্বাবধান করে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয়। বাংলার নবাবদের ব্যবহৃত এবং তখনকার ব্রিটিশদের ব্যবহৃত জিনিস এবং বিভিন্ন শৌখিন জিনিসপত্র এখানে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আসবাবপত্র, সোনা ও রূপার তৈরি বাসনপত্র, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি, নানা ধরনের বই - যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো "আইন-ই-আকবরি"র পাণ্ডুলিপি এবং সোনা দিয়ে মোড়ানো কোরআন শরিফ। রয়েছে নবাবদের ব্যবহৃত অস্ত্র। তারমধ্যে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত সিরাজউদ্দৌলার তলোয়ার এবং বন্দুক ও রয়েছে, আলিবর্দী খাঁয়ের তরবারি রয়েছে আবার দর্শকদের জন্য রয়েছে সেই ছুরি যা দিয়ে মীরজাফরের আদেশে সিরাজকে হত্যা করেছিল মহম্মদ-ই-বেগ।
কতো যে জিনিস আছে এই হাজারদুয়ারী প্রাসাদের মিউজিয়ামে তা বলে শেষ করা যাবে না। এই বিশাল সংগ্রহশালা ঘুরে ঘুরে পুরোটা দেখতে একদিন তো সময় লেগে যাবেই। পরের পর্বে তাহলে আমরা বরং বাকি জায়গাগুলোতে বেড়াতে যাবো?