হাজারদুয়ারী প্রাসাদ দেখা শেষ করে চলুন আমরা দেখতে যাই নিজামত ইমামবাড়া। আসলে মুর্শিদাবাদ মানেই ইতিহাসের চলমান প্রদর্শনী। এত দেখার জিনিস যে কোনটা আগে দেখবেন তা নিয়ে বিভ্রান্তি হওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
ভাগিরথী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ‘কিলা নিজামত’ নামক একটি এলাকার মধ্যেই অবস্থিত হাজারদুয়ারী এবং আরো বেশ কিছু অট্টালিকা। কিলা বা কেল্লা শব্দের অর্থ 'দুর্গ'। দিল্লির মুঘল বাদশারা যেমন লালকেল্লায় বসবাস করতেন, ঠিক তেমনি বাংলার নবাবরা বাস করতেন মুর্শিদাবাদের "কেল্লা নিজামত" বা নবাবি দুর্গে। মুর্শিদাবাদের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাগীরথী নদীর পূর্ব পাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল এই কেল্লা। কালের প্রভাবে আজ আর নবাবি কেল্লার অস্তিত্ব আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। যখন মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানী ছিল সেইসময় এ কেল্লার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সমগ্র অঞ্চলটি ছিল নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় আবৃত। কেল্লার ভিতরে প্রবেশের জন্য একটি প্রধান দরজা সহ আরও বেশ কয়েকটি দরজা ছিল। ভিতরে ছিল নবাব ও তাঁর আত্মীয় স্বজনদের বসবাস এবং প্রশাসনিক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য ও গড়ে তোলা হয়েছিল বেশ কয়েকটি প্রাসাদ। ছিল বহু মসজিদ, ইমামবাড়া, স্বাস্থ্যকেন্দ্র সহ নানা রকমের ছোট, বড় ভবন। এই পরিধির মধ্যেই একইসাথে অবস্থিত ‘নিজামত ইমামবাড়া’, ‘ওয়াসিফ মঞ্জিল’, ‘বাচ্চাওয়ালি তোপ’ এবং ‘মুর্শিদাবাদ ক্লক টাওয়ার'..
হাজারদুয়ারী প্রাসাদের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে 'নিজামত ইমামবাড়া'। শিয়া মুসলমানদের জমায়েত স্থল এই ইমামবাড়া শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা ভারতের বৃহত্তম ইমামবাড়া। প্রথমবার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এই ইমামবাড়াটি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেই স্থাপত্য মূলত কাঠ দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ভয়াবহ আগুন লেগে সেই ইমামবাড়াটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে নবাব মনসুর আলী ফেরাদুন জা প্রায় সাত লক্ষ টাকা ব্যয়ে ইমামবাড়াটি পুনর্নির্মাণ করেন।
হাজারদুয়ারী প্রাসাদ এবং নিজামত ইমামবাড়ার মধ্যবর্তী জায়গাটিতে রয়েছে একটি ছোট আকৃতির মদীনা মসজিদ। এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। এই মসজিদের এবং ইমামবাড়ার নীচে রয়েছে মক্কার পবিত্র মাটি। গরীব মুসলমান রাজ্যবাসী যাদের পক্ষে হজ করার জন্য মক্কা যাওয়া সম্ভব হয়নি অর্থাভাবে, তাদের কথা ভেবে সিরাজের নির্দেশে এই ইমামবাড়ার নীচে ছ ফুট গর্ত করে সেখানে মক্কা থেকে আনা মাটি দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিল। মসজিদের ভিতরেও রাখা হয়েছিল সেই পবিত্র মৃত্তিকা।
একসময় নবাবি কেল্লার জৌলুশ ছিল দেখার মতো। প্রধান ফটক থাকত কড়া নিরাপত্তায় মোড়া। নিরাপত্তা ভেদ করে মাছিরও কেল্লার ভেতরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। নবাবি আমলে কেল্লার প্রধান ফটক ‘দক্ষিন দরজার’ মাথায় থাকত নহবৎখানা। সেখানে বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্রীরা সকাল-সন্ধ্যা সানাই বাজাত। এখন সেই সব কিছুই আর নেই। শুধু ইট কাঠ পাথরে নবাবী আমলের ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে কিছু অট্টালিকা এবং কিছু স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ।
কেল্লার পাশেই বয়ে যাওয়া ভাগীরথীতে ভেসে থাকত বহু দাঁড় যুক্ত নবাবি নৌকা। এই সব নৌকায় নবাবি পতাকা উড়ত পতপত করে। নবাবরা নৌকা করে যাতায়াত করতেন রাজমহল, ঢাকা কিংবা কলকাতায়। কখনও বা নৌকা নিয়ে বৈকালিক ভ্রমণে বেরোতেন। হাজারদুয়ারি ঘাটে সারিবদ্ধ ভাবে সব রাজকীয় নৌকাগুলি নদীতে বাঁধা থাকত। এখনও কেল্লার ওই ঘাট রয়ে গেছে। কিন্ত রাজকীয় নৌকাগুলি আজ শুধুই স্মৃতি মাত্র। কেল্লা চত্ত্বরের মধ্যে রাজকীয় প্রাসাদ আয়নামহল,আংনা মহল, সোনা মহল, চাঁদি মহলের আজ আর অস্তিত্বই নেই।
এর পরের পর্বে আলোচনা করবো মুর্শিদাবাদ জেলার আরো কিছু দর্শনীয় স্থান, স্থাপত্য, বিখ্যাত মানুষ, জিনিসপত্র, শাড়ি, মিষ্টি এবং, এবং, এবং...যে ফলটার জন্য আমরা প্রখর গ্ৰীষ্ম ঋতুকেও পরম আদরের বলে মনে করি সেই অমৃতসম মুর্শিদাবাদী 'আম' নিয়ে। অনেক গল্প এখনো বাকি আছে বন্ধুগণ। এই মজাদার শীতের আমেজ নিয়ে একটু অপেক্ষায় থাকুনই না হয়।