গত সপ্তাহে যেখানে শেষ করেছিলাম সেখান থেকেই শুরু করি? মনে আছে তো? আমি জানি আপনাদের মনে থাকবেই। কারণ খাবার দাবার নিয়ে লিখতে বা পড়তেও ভারি চমৎকার লাগে তাই না?
তাহলে আবার চলে যাওয়া যাক মুর্শিদাবাদ জেলার বিখ্যাত কিছু মিষ্টির খবরাখবরে! ছানাবড়া কেমন খেতে সেটা আগের পর্বেই লিখেছিলাম। এবার তার ইতিহাস, ভূগোল নিয়ে কিছু তথ্য জানানো যাক। ঠিক কবে এই মিষ্টির উদ্ভব ঘটেছিল সে সম্পর্কে তেমন কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় ছানাবড়া প্রথম তৈরি হয়েছিল নবাবি আমলেই।
জনশ্রুতি, নবাবি আমলের প্রায় শেষের দিকে মুর্শিদাবাদ শহরে নিমাই মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি শহরের বুকে একটি মিষ্টির দোকান দিয়েছিলেন। সেই দোকানের ছানাবড়া নাকি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই দোকান থেকে ছানাবড়া নাকি নিয়মিত নবাব প্রাসাদে সরবরাহ করা হত। নবাবদের ছানাবড়া প্রীতির গল্প কতখানি সত্যি তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবারে যে মাঝে মাঝেই ছানাবড়ার প্রবেশ ঘটত, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
মুর্শিদাবাদে ছানাবড়ার তৈরির দু’জন বিখ্যাত কারিগর ছিলেন সৈদাবাদের পটল সাহা ও গোপেশ্বর সাহা। মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত মিষ্টির কারিগর বা মিষ্টান্ন শিল্পীদের বলা হত "ওস্তাদ"।
পটল সাহাও তাই পটল ওস্তাদ নামেই খ্যাত ছিলেন। তাঁর হাতের ছানাবড়া খেয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি রাজারাজরাও মুগ্ধ হতেন। কাশিমবাজারের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীরও খুব পছন্দের মিষ্টি ছিল ছানাবড়া। এবং তাঁর হাত ধরেই ছানাবড়ার সুনাম মুর্শিদাবাদ জেলার সীমানা পেরিয়ে বহু দূর অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল।
শোনা যায় নবাবের আমলে একটি ছানাবড়ার ওজন হতো এক কুইন্টাল। এখনকার ‘ওস্তাদ’রা ততটা বিশাল মাপের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি তৈরি করতে না পারলেও ২০ কেজি, ১০ কেজি বা ৫ কেজি ওজনের ছানাবড়া তৈরি করতে তাঁরা সত্যিই ওস্তাদ। ২০০৮ সালের একটি অনুষ্ঠানে ৩০ কেজি ওজনের একটি ছানাবড়া দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। এমন কি রাহুল গান্ধী, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এখানকার বিশেষ এই মিষ্টির প্রশংসা করেছেন। তাই বহরমপুরের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা চাইছেন এই মিষ্টিও ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ বা জিআইয়ের তকমা পাক। ছানাবড়ার এমন স্বাদ আর অন্য কোনও রাজ্যে, কোনো জেলায়ও পাওয়া যায় না।
ছানাবড়া ছাড়াও আরো দুটি বিখ্যাত মুর্শিদাবাদী মিষ্টি হল আজিমগঞ্জের চমচম এবং বেলডাঙার মনোহরা। আমাদের রাজ্যের এই বিশেষ মিষ্টিগুলির তুলনা শুধু ভারত নয় সারা পৃথিবীতেও পাওয়া যাবে না একথা আমরা, বাংলাবাসীরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি।
এবার আসি আমের কথায়। অমৃতসম এই ফলটির ভক্ত দরিদ্র থেকে নবাব বাদশা সকলে। আম "আম আদমির" পছন্দের ফল হলেও নবাব বাদশাদের পছন্দ বলে কথা। মুর্শিদাবাদে বহু প্রজাতির আমের ফলন হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো "কোহিতুর".... নামটা শুনলেই যে জিনিসটার কথা মনে পড়ে যায় সেই "কোহিনূর" এর মতোই দামী এবং শৌখিন আম এটি। মীরজাফর পুত্র মীরণ যার নিষ্ঠুরতার কুখ্যাতি আজো মানুষের মনে ঘৃণার সঞ্চার করে সেই মীরণ নাকি খুব যত্নের সঙ্গে কোহিতুর আমগাছের বাগান বানিয়েছিলেন এবং প্রত্যেকটা গাছকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করতেন। কী অদ্ভুত চরিত্র না!
মুর্শিদাবাদী সিল্কের সুনাম ও সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। খাগড়ার কাঁসা পিতলের ও সুখ্যাতি রয়েছে।
এবার মুর্শিদাবাদ জেলার বিখ্যাত কিছু মানুষের কথা উল্লেখ করতেই হবে। প্রথমে যার নাম বলবো স্কুলে ইতিহাস পড়ার সময় আজও তাঁর নাম আমরা পড়ি। মহেঞ্জোদারো হরপ্পা আবিষ্কারের সঙ্গে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি হলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর বলব মহাশ্বেতা দেবী এবং ঋত্ত্বিক ঘটকের নাম। এঁদের পরিচয় আমি এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষ আর কী দেব। নিজেদের প্রতিভার আলোকে এরা আমাদের আলোকিত করেছেন। এবার যার নাম লিখছি তাঁর গানে মুগ্ধ সারা দেশের মানুষ। তিনি অরিজিৎ সিং। তিনি কিন্তু মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র। এরা ছাড়াও আরো বহু মানুষ আছেন যারা তাদের বিদ্যায়, মেধায়, জ্ঞানে, সৃষ্টিতে আমাদের মুগ্ধ করেছেন, এই বঙ্গভূমি গর্বিত হয়েছে তাঁদের জন্য।
মুর্শিদাবাদ জেলার কথা এবারের মতো শেষ করি। পরের সপ্তাহে নতুন জেলা কথা নিয়ে আসব কেমন?