আগের পর্বেই লিখেছিলাম যে এবার অন্যরকম ইতিহাসের খোঁজে বেরোব আমরা। প্রথমে মালদহের লোকজ সংস্কৃতি গম্ভীরা নৃত্য নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। গম্ভীরা নৃত্য বা গম্ভীরা নাচ মালদহ জেলার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গম্ভীরা উৎসবে মুখোশ পরে বা মুখোশবিহীনভাবে পরিবেশিত একক বা দলবদ্ধ নৃত্য হলো গম্ভীরা নৃত্য। শিবের এক নাম হল গম্ভীর।
মূলত চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবের পুজো উপলক্ষে গাজনের উৎসবে গম্ভীরা নৃত্যশিল্পীরা নাচ গানের মাধ্যমে বছরের প্রধান ঘটনাবলী, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আনন্দ ও দুঃখ, কিছু কিছু আন্তর্জাতিক বিষয় দর্শকদের সামনে তুলে ধরে তাদের আনন্দ দিয়ে থাকেন।
এখন তো বসন্ত কাল। বসন্তের মিঠে মিঠে দখিনা বাতাস গায়ে মেখে এবার "গম্ভীরা" ছেড়ে চলুন আমাদের সেই অন্যরকম "মিষ্টি মিষ্টি" ইতিহাসের চলমান প্রদর্শনী একটু দেখে নিই, সঙ্গে সঙ্গে চেখেও নিই।
মিঠাইয়ের নাম রসকদম্ব। সেই সময় এই মালদার নাম ছিল গৌড়। শাসক সুলতান হুসেন শাহ। তাঁরই আমলে গৌড়ের রামকেলিতে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। কথিত আছে যে কেলিকদম্ব গাছের নিচে বসে তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন রূপ আর সনাতনকে।
মনে করা হয় সেই কদম্ব গাছকে স্মরণ করে এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর রামকেলি আগমণকে স্মরণীয় করে রাখতে রসকদম্ব তৈরি করেছিলেন মিষ্টান্ন কারিগরেরা। একেবারে কদম ফুলের মতো দেখতে এই মিষ্টির স্বাদের কোনো তুলনা নেই। ওপরে শক্ত ক্ষীরের প্রলেপ। ভেতরে নরম রসগোল্লা। বাইরের ক্ষীরের আস্তরনের ওপর পোস্তদানা লাগানো হয়।
অতি সুস্বাদু এই মিষ্টির চাহিদা মালদহ জেলার প্রায় প্রতিটি ঘরেই। যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে সে বিয়েবাড়ি হোক বা ছোটখাটো ঘরোয়া জমায়েত.. .রসকদম্ব যাকে বলে "মাস্ট"। এই মিষ্টির সুখ্যাতি এখন মালদহ ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলা তো বটেই এমনকি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
যেহেতু বেশ কয়েকদিন রেখে দিলেও রসকদম্ব নষ্ট হয় না তাই মালদায় বেড়াতে এসে মিষ্টিপ্রেমী মানুষ বাক্স ভর্তি করে রসকদম্ব নিয়ে যান। এই বিষয়ে একটা ছোট্ট ব্যক্তিগত তথ্য জানাই? এই নিবন্ধ লেখিকার মামাবাড়ি ছিল একেবারে মালদা টাউনের উপর। আর কথাতেই আছে "মামাবাড়ি ভারি মজা"। তাই একবার নয়, বহুবার এই অপূর্ব মিঠাইটির স্বাদ পাওয়ার অভিজ্ঞতা এই লিখিয়ের রয়েছে। সেই স্বর্গীয় সুখ বা অনুভবের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে আর অন্যের দীর্ঘশ্বাসের কারণ হতে চাই না।
রসকদম্ব ছাড়াও মালদায় একসময় বিখ্যাত ছিল হালুয়া পট্টি আর টাড়ার খাজা। এই দুটোই সুলতান হুসেন শাহের আমলের মিষ্টি। কিন্তু হালুয়া পট্টি আর খাজা এখন আর পাওয়া যায় না। শোনা যায় সুলতানি আমলের শেষের দিক থেকেই নাকি বিলুপ্ত হতে শুরু করেছিল এই মিষ্টিগুলি।
মালদার আরেকটি বিখ্যাত মিষ্টি হল কানসাট। এই অনন্য মিষ্টিটি আবিষ্কার হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের "কানসাট" নামের একটি জায়গায়। উদ্ভাবক ছিলেন বাংলাদেশের শিবগঞ্জ জেলার প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী মহেন্দ্রনাথ সাহা। পরে তিনি এই বাংলার মালদহে এসে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন এবং তার পুত্র বিজয় কুমার সাহার হাতেই মালদায় কানসাটের জয়যাত্রা শুরু হয়।
বাংলাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এই মিষ্টির নামে এখনো আস্ত একটা জনপদ আছে। বিজয় কুমার তাদের পৈতৃক ভূমির নামেই বাবার শেখানো এই বিশেষ মিষ্টিটির নাম রাখেন।দেশভাগের স্মৃতি আজও মনে করিয়ে দেয় মালদার এই প্রসিদ্ধ মিষ্টি।
আরো বাকি রয়েছে বন্ধু। মালদা জেলার সবথেকে বিখ্যাত ফলটার কথা কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? ঠিক ধরেছেন। আমি আমার আপনার সবার প্রিয় আমের কথাই বলছি। শুধু মুর্শিদাবাদ জেলা নয়, আমের জন্য প্রসিদ্ধ মালদাও। বিশেষ করে ফজলি এবং হিমসাগর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তো বটেই, বিদেশেও রফতানি হয় মালদার আম।
সম্প্রতি মালদায় ম্যাঙ্গো ট্যুরিজম চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচার নিয়ন্ত্রণাধীন সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট ফর সাবট্রপিক্যাল হর্টিকালচারের মালদা শাখা। পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে যে সরকারি সহায়তায় এখানে ম্যাঙ্গো ট্যুরিজম শুরু করা হবে। আমের সময় ট্যুরিস্টরা এসে আমবাগানে তৈরি কুঁড়েতে থাকবেন৷
বিভিন্ন ধরনের আমের স্বাদ নেবেন৷ একই সঙ্গে আম থেকে উৎপন্ন উপজাত খাদ্যসামগ্রীগুলির (যেমন আমসত্ত্ব, আমের আচার ইত্যাদি) স্বাদও তাঁরা নিতে পারবেন৷ পাশাপাশি এখানে সকলে ম্যাঙ্গো মিউজিয়াম দেখেও আনন্দ পাবেন৷ সব কিছু ঠিক থাকলে আমরা আগামী বছরই এই ট্যুরিজম চালু হতে পারে৷
মালদহ জেলায় জ্ঞানী গুণী মানুষের তো অভাব নেই। এই জেলায় রয়েছে একাধিক বিখ্যাত স্কুল (মালদহ রামকৃষ্ণ মিশনের নাম এইক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য), কলেজ, ইউনিভার্সিটি (গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়) এবং মালদহ মেডিকেল কলেজ। তবুও মালদা বললেই যে মানুষটির নাম মনে পড়ে তিনি হলেন গনিখান চৌধুরী... ভারতের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী এই মানুষটি তাঁর নিজের জেলার উন্নয়নের জন্য আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছিলেন। এই জেলায় রয়েছে ফারাক্কা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সবকিছু নিয়ে মালদহকে একটি বর্ধিষ্ণু জেলা বলা যেতেই পারে।
মালদহ জেলাকাহন এবার শেষ করি? পরের সপ্তাহে আবার নতুন জেলাকথা নিয়ে আসব।