জেলার নাম মালদহ - পর্ব ৪

গত সপ্তাহে শেষ করেছিলাম মালদার রামকেলি গ্ৰাম দিয়ে। এই সপ্তাহে শুরুও করি সেখান থেকেই। আজ থেকে ছশো বছরেরও বেশি আগেকার কথা। সালটা ছিল ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দ। এই সময় বৃন্দাবনে যাওয়ার পথে শ্রীচৈতন্যদেব গৌড়ের রামকেলি গ্রামে পদার্পণ করলেন এবং কয়েকদিন সেখানে থাকলেন।

তখনকার বাংলার সুলতান হুসেন শাহ তাঁর রাজসভার দুই কর্মচারী সাকর মল্লিক এবং দবির খাসকে এই নতুন আগত বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারকের সেবাযত্নের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তিবাদের প্রভাবে এসে এতটাই অভিভূত হলেন যে এই দুই রাজকর্মচারী জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি তিথিতে শ্রীচৈতন্যদেবের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন এবং পরবর্তীকালে তাঁরা রূপ এবং সনাতন গোস্বামী নাম নিয়ে চাকরি ত‌্যাগ করে মহাপ্রভুর আদেশে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের কাজে নিজেদের নিয়োগ করেন।

কথিত, এই রামকেলিতে যে তমাল গাছের নীচে বসে শ্রীচৈতন্যদেব দীক্ষা দিয়েছিলেন সেই গাছটি এখনো জীবিত এবং তার নীচে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পদচিহ্ন রয়ে গেছে। এই গাছের নীচে একটি মন্দিরের মধ্যে সেই পায়ের চিহ্ন রয়েছে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে এই রামকেলি গ্ৰাম বৈষ্ণবদের কাছে অতি পুণ্যভূমি।

শুধু বৈষ্ণব নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের কাছেও রামকেলি একটি তীর্থস্থান বিশেষ। এই রামকেলি গ্ৰাম অন্য কারণেও প্রসিদ্ধ। ভারতবর্ষে কেবল এই স্থানেই জ্যৈষ্ঠমাসের সংক্রান্তির দিনে মন্দিরের পাশেই গৌড়েশ্বরী থানে মহিলা পুণ্যার্থীরা তাদের প্রয়াতা মায়ের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করতে পারেন। এই রামকেলির অন্য আরেকটি নামও রয়েছে---গুপ্ত বৃন্দাবন।

এইবার চলুন মালদায় অন্যান্য বিখ্যাত দ্রষ্টব্যগুলিও একটু ঘুরে ফিরে দেখি। মানস ভ্রমণ যখন তখন সবকিছুই দেখে নেব অল্প সময়ের মধ্যেই। কত কিছু এখনো দেখা বাকি। আদিনা মসজিদ, বড় সোনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা, ফিরোজ মিনার, লুকোচুরি মসজিদ এই অপরূপ স্থাপত্যগুলো ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এইবার চলুন শুরু করি। দেখতে যাই গৌড়-পাণ্ডুয়ার মসজিদ। ১৩৬৯ সালে গৌড়ের সুলতান সিকান্দার শাহ নির্মিত আদিনা মসজিদকে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। অষ্টম শতকে দামাস্কাসে তৈরি হওয়া এক মসজিদের আদলে এটি তৈরি করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

এবার বড় সোনা মসজিদ বা বারোদুয়ারি মসজিদ। রামকেলির দক্ষিণ দিকে আধ কিলোমিটার দূরত্বে এই বড় সোনা মসজিদ প্রাচীন গৌড়ের সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্থাপত্য কীর্তি। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এই অনন্য স্থাপত্যের নির্মাণ কাজ শুরু করলেও শেষ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

তখন তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন নসরৎ শাহ্ এই মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করিয়েছিলেন। এই মসজিদের বারোটি প্রবেশপথ বা দ্বার রয়েছে তাই সম্ভবতঃ লোকের মুখে মুখে এর নাম বারদোয়ারী (অর্থাৎ বারোটি দরজাযুক্ত) হয়ে গেছে। কিন্তু এখন এর এগারোটি দরজা রয়েছে। এই মসজিদের ইন্দো-আরবি স্থাপত্যশৈলী এবং অপরূপ পাথরের খোদাই কার্য‌্য দেখে আমার মতো আপনারাও মুগ্ধ হতে বাধ্য।

এবার কোথায় যাওয়া যায় বলুন?
চলুন এবার দেখে নেওয়া যাক দাখিল দরওয়াজা। দরওয়াজা অর্থাৎ বুঝতে পারছেন এটি একটি প্রবেশদ্বার। ১৪২৫ সালে নির্মিত ছোট ছোট লাল ইট এবং পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি এই স্থাপত্য বা দ্বারটি ২১ মিটারেরও বেশি উঁচু এবং ৩৪.৫ মিটার চওড়া। আগে এখান দিয়ে কামানের গোলা ছড়া হত তাই এই দরজার আরেকটি নাম সালামি দরওয়াজা। প্রায় সাতশো বছরের পুরানো ইতিহাস যেন কথা বলে ওঠে এখানে,
তাই না?

আজ এইটুকু থাক কেমন? বেড়ানো আরো বাকি আছে বন্ধুগন। পরের পর্বে নাহয় যাওয়া যাবে সেসব চমৎকার জায়গাগুলিতে?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...