জেলার নাম মালদহ - পর্ব ৩

বাংলার জেলা-কথায় এবার মালদহ জেলার তৃতীয় পর্বে চলে এলাম। মালদহ তথা গৌড়ের ইতিহাস বহু প্রাচীন। কিন্তু অতীতে গৌড় নামের এক সমৃদ্ধ জনপদ থাকলেও মালদহ নামে আলাদাভাবে কোন জেলা ছিল না। কখনও বৌদ্ধ, কখনও হিন্দু তো কখনও মুসলিম এবং সবশেষে প্রবল ইংরেজ এসে এই জনপদে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে দেখিয়েছে তাদের তেজ। তাদের রেখে যাওয়া নিজ নিজ সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শনে রঙিন মালদহ যেন এক টুকরো ভারত।

জেলা হিসেবে মালদহের আত্মপ্রকাশ ব্রিটিশ শাসনকালে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করে ১৭৬৫ সালে।এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭১ সালে মহানন্দা নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত মকদুম্পুর, সিঙ্গাতলা, কুতুবপুর এবং হায়দারপুর এই চারটি গ্রাম নিয়ে গড়ে তোলে ইংরেজবাজার নামে একটি বাণিজ্যিক কুঠিভবন। ডঃ বুচানান হ্যামিলটন রচিত মালদহের গৌড় ও পান্ডুয়ার এক ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায় যে উনিশ শতকের গোড়ায় মালদহ কোন আলাদা জেলা ছিল না।

বর্তমান মালদহ জেলার কিছু অংশ ছিল বিহারের পূর্ণিয়া জেলায়। বাকি অংশ ছিল দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত। ১৮১৩ সাল নাগাদ ঐ এলাকায় ব্যাপক হারে চুরি ডাকাতি বেড়ে যেতে থাকে। তখন তো সেখানকার মানুষ প্রচণ্ড রেগে উঠলো। বাধ্য হয়ে নড়েচড়ে বসল প্রশাসন। তৎকালীন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট সেইসময় প্রসাশনিক সুবিধার জন্য সেই এলাকায় নতুন জেলা গঠনের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সুপারিশ করলেন।

ওই সুপারিশ অনুযায়ী কোম্পানি ১৮১৩ সালের মার্চ মাসে বিহারের পূর্নিয়া জেলার শিবগঞ্জ , কালিয়াচক, ভোলাহাট ও গুরগুরিবা (রতুয়া) থানা, দিনাজপুর জেলার মালদহ ও বামনগোলা থানা এবং রাজশাহী জেলার রোহনপুর ও চাঁপাই (নবাবগঞ্জ) এই আটটি থানা নিয়ে মালদহ নামে একটি নতুন জেলা গঠন করল।

১৮৫৯ সালে একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর নিযুক্ত করা হলে ওই বছর মালদাহ একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা পায়। ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় পর্যন্ত মালদহ জেলা রাজশাহী বিভাগের অধীনে ছিল।

এর পরের কাহিনী তো প্রথম পর্বেই লিখেছি। এ তো গেল মালদহ জেলা তৈরির ইতিহাস। এবার আসি মালদার বিশেষ বিশেষ দ্রষ্টব্য বা বিখ্যাত কিছু স্থান নিয়ে। প্রথমেই যে জায়গাটার নাম বলবো তা হলো রামকেলি। এই রামকেলি মালদহের একটি সমৃদ্ধ গ্ৰাম। প্রাচীন গৌড় যা ছিল বল্লাল সেনের রাজধানী সেই গৌড়ের নাম লক্ষণ সেন দিয়েছিলেন লক্ষণাবতী।

এই লক্ষণাবতীর পাশেই ছিল রামকেলি। এই গ্ৰামের নাম রামকেলি কীভাবে হল সে বিষয়ে কোন বিশেষ তথ্য পাওয়া যায়না। তবে জনশ্রুতি এই যে শ্রী শ্রীরামচন্দ্র একবার সীতা এবং হনুমানকে নিয়ে মিথিলা যাওয়ার পথে এই অঞ্চলে এসেছিলেন এবং এই মালদহ বা পুণ্ড্রদেশে ক'দিন বাস করেছিলেন। সেখানে কালিন্দী নদীর তীরে এক আমবাগানে আমের স্বাদ ও গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে শ্রীরামচন্দ্র ফলকেলি অর্থাৎ ফল নিয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনা থেকেই লোকের মুখে মুখে এই গ্ৰামের নাম হয়ে যায় "রামকেলি"।

কিন্তু এর কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। এই কিংবদন্তী ছাড়াও রামকেলির ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধি কম নয়। স্বয়ং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণধূলি পড়েছিল এই রামকেলি গ্ৰামে। বৃন্দাবন দাস রচিত চৈতন্যভাগবত গ্ৰন্থে উল্লিখিত রয়েছে এই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা এবং এই গ্ৰামের নাম।

"গৌরের নিকটে গঙ্গাতীরে এক গ্ৰাম
ব্রাহ্মণ সমাজ তার রামকেলি নাম"....

আজ এই পর্যন্ত থাক পাঠক বন্ধুরা? আরো অনেক "কথা ও কাহিনী" নিয়ে পরের পর্বে আসব।।


ঋণ: চৈতন্যভাগবত: শ্রীবৃন্দাবন দাস।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...