জেলা পর্বে এবারের মতো বর্ধমান জেলার শেষ পর্বে এসে পৌঁছেছি। কোনও জায়গা থেকে বিদায় নিতে হলে শেষে কোন কাজটা করতে হয় বলুন তো বন্ধুরা? ঠিক ধরেছেন, সেখানকার বিখ্যাত মিষ্টিগুলো চেখে দেখতে হয় এবং ভালো লাগলে প্রাণ ভরে খেতে হয়। এই পর্বে চলুন জেনে নেওয়া যাক বর্ধমান জেলার সবথেকে বিখ্যাত মিষ্টিগুলো কী কী এবং সেগুলোর জন্মকথা।
বর্ধমান বললেই প্রথম যে মিষ্টিটার নাম মনে আসে– 'মিষ্টিটা' বললে ভুল হবে, বলা উচিত, যে মিষ্টিদুটোর নাম মনে আসে সে দুটো হল সীতাভোগ এবং মিহিদানা। এই সীতাভোগ এবং মিহিদানা এখন বর্ধমান জেলার এমনকি আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নামের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়। বর্ধমানে বেড়াতে গিয়ে সীতাভোগ মিহিদানা খাননি বা বাড়ির জন্য নিয়ে আসেননি এমন মানুষ বোধহয় পাওয়া যাবে না। বর্ধমানের সাধারণ মানুষ কিন্তু রীতিমত অহঙ্কার বোধ করেন তাঁরা ‘মিহিদানার শহরের মানুষ’ বলে। সুকুমার রায়ের লেখা পাগলা দাশুর গল্প "চিনে পটকা" মনে আছে? সেই যে গল্পে পাগলা দাশু মিহিদানার হাঁড়িতে পটকা ফাটিয়ে কী দুষ্টুমিই না করেছিল!
এবার এই জগদ্বিখ্যাত মিষ্টিদুটির ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। এই যে সীতাভোগ আর মিহিদানা এদের বয়স কিন্তু মোটামুটি একশো পনেরো। পাঠক বলবেন "মিষ্টিরও আবার বয়স? সেটা কেমন?"
আছে বন্ধুরা, মিষ্টিরও নতুন পুরনো আছে। বয়স বলতে আবিষ্কারের সময়কাল। তাহলে শুরু করা যাক সীতাভোগ মিহিদানা আবিষ্কারের ইতিকথা।
তখন ইংরেজ শাসনকাল চলছে ভারতে। সময়টা ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাস। ভাইসরয় লর্ড কার্জন গেছেন বর্ধমানে। সেই লর্ড কার্জন যে পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৫এ বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব এনেছিলেন। কিন্তু তিনি হলেন লাটসাহেব। তাঁর আপ্যায়নে ত্রুটি থাকলে চলে? তাই তাঁর আগমন উপলক্ষ্যে বানিয়ে ফেলা হল কার্জন গেট। সেইসময় বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহতাব। তাঁর সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক খুবই মধুর। তিনি ঠিক করলেন বড়লাটকে নতুন ধরনের কোনও মিষ্টি খাইয়ে একেবারে অবাক করে দেবেন। এমন হবে সেই মিষ্টি যা অন্য মিষ্টির মতো দুধের তৈরি নয়।
কিন্তু তার স্বাদ হবে অতি উত্তম। ডেকে পাঠালেন বর্ধমানের সেরা হালুইকর ভৈরব চন্দ্র নাগকে। বললেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। যেমনি বলা তেমনি কাজ। ভৈরব বাবু ভেবেচিন্তে বানিয়ে ফেললেন একেবারে নতুন ধরনের দু’রকমের মিষ্টি। এই মিষ্টিগুলি দুধের তৈরি নয়; ঘি, চালের গুঁড়ো, ব্যাসন, দারুচিনি, লবঙ্গ আর চিনি — এই ক'টি উপকরণ দিয়ে বানিয়ে ফেললেন নতুন মিষ্টি সীতাভোগ এবং মিহিদানা।
লর্ড কার্জন এই মিষ্টি খেয়ে এমন মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি নাকি হুকুম জারি করে দিয়েছিলেন যে পরবর্তী যে কোনও সরকারি ভোজসভায় সীতাভোগ, মিহিদানা যাকে বলে ‘মাস্ট’ - আইটেম হিসেবে থাকবেই।
এই হল সীতাভোগ, মিহিদানার আবিষ্কারের ইতিহাস এবং তাদের জয়যাত্রার কাহিনী। এখনো পর্যন্ত দেশ বিদেশের মানুষের কাছে বর্ধমান মানেই সীতাভোগ মিহিদানার শহর।
এরপর বর্ধমান জেলার আরেকটি বিখ্যাত মিষ্টি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানানো যাক। সেই মিষ্টিটি হল ল্যাংচা যার জন্মভূমি বর্ধমান জেলার আরেক শহর শক্তিগড়। শক্তিগড়ের ল্যাংচার নাম শুনে জিভে জল আসে না এমন বাঙালি খুব কম আছে। শুধু বাঙালি কেন, বাংলার বাইরে অন্যান্য প্রদেশের বা অন্য দেশের মানুষরাও যারা শক্তিগড়ের ল্যাংচা খেয়েছেন একবাক্যে তারা বলবেন ‘লা-জবাব’।
এইবার শক্তিগড়ের ল্যাংচা কী করে আবিষ্কার হল তার পেছনে রয়েছে এক মজার গল্প। ল্যাংচা–আমরা তো কত রকমের মিষ্টি খেয়ে থাকি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ধরনের মিষ্টির নাম কি কখনো শুনেছি? কিন্তু তার এরকম একটা অদ্ভুত নাম হল কী করে! সেই নামের পেছনেও রয়েছে মজাদার এক কিসসা। শুনে নেওয়া যাক কী এমন সেই কাহিনি!
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের এক কন্যার বিয়ে হয়েছিল বর্ধমানের রাজপরিবারের এক ছেলের সঙ্গে। কিছুদিন পর সেই নববধূ সন্তানসম্ভবা হল। রাজপরিবারের সবাই তো খুব খুশি। বধূর যত্নআত্তির দায়িত্ব নিলেন তার শাশুড়ি মা অর্থাৎ রানীমা। কিন্তু বধূর কোনও সুখাদ্যই মুখে রোচে না। সব খাবারেই তার অরুচি। রানীমা নিজের হাতে তার পুত্রবধূর জন্য নানান সুখাদ্য প্রস্তুত করে নিয়ে আসেন। কিন্তু পুত্রবধূর সেসব খাবার ভালোই লাগে না। চিন্তিত মহারানীমা বৌমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন "মা, তোমার কী খেতে ইচ্ছে করে তুমি আমাকে বলো। আমি আজই সেই খাবার বানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি" প্রথমে বধূ লজ্জায় কিছুই বলতে চায় না তারপর মৃদু স্বরে মুখ নীচু করে বলে ‘ল্যাংচা’।
ল্যাংচা! এমন খাবারের নাম তো কখনো রানীমা শোনেননি! রাজ পরিবারের সদস্যরা কেউই শোনেনি। এমন খাবার কোথায় পাওয়া যায়? অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে বধূর কাছ থেকে জানা গেল যে তার পিত্রালয়ে অর্থাৎ কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে সে একধরনের মিষ্টি খেয়েছিল। তার নাম সে জানে না কিন্তু যে ময়রা এই মিষ্টি তৈরি করত তার একটি পা খোঁড়া। গ্ৰাম্য ভাষায় খোঁড়া মানুষকে ল্যাংড়া বলা হয়। তাই খোঁড়া মিষ্টান্ন শিল্পীর তৈরি বিশেষ সুস্বাদু মিষ্টিটিকে সেই বধূ নাম দিয়েছিল "ল্যাংচা"।
এই কথা শুনে বর্ধমান-রাজ তক্ষুনি দূত পাঠালেন কৃষ্ণনগরে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সব শুনে সানন্দে সেই খোঁড়া হালুইকরকে পাঠিয়ে দিলেন বর্ধমানে।
তখন বর্ধমানের মহারাজ সেই ময়রাকে বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের কাছেই এক গ্ৰামে জমি দিলেন, বাড়িঘর বানিয়ে দিলেন। সেই ময়রা বড় এক মিষ্টির দোকান দিল শক্তিগড়ে। প্রতিদিন একমণ করে সেই বিচিত্র মিষ্টি সরবরাহ করা হত বর্ধমান রাজপ্রাসাদে। রাজবধূ তো তার প্রিয় মিষ্টি পেয়ে ভারি আহ্লাদিত; পাশাপাশি রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও ল্যাংচার স্বাদে মুগ্ধ। ল্যাংড়া ময়রার সেই অপরূপ স্বাদের ঘিয়ে ভাজা রসালো মিষ্টি ল্যাংচা নামে বিখ্যাত হয়ে গেল। আজও গাঢ় খয়েরী রঙের লম্বাকৃতি রসে টইটম্বুর এই মিষ্টিটি মানুষের হৃদয় এবং পেট - দুইই জয় করে নেয়।
তাহলে বন্ধুরা, এই সুন্দর সুন্দর মিষ্টিগুলো দিয়েই বর্ধমান জেলা পর্ব শেষ করা যাক। পরের পর্বে আসবে নতুন জেলা কথা। ভালো থাকবেন সবাই।