বর্ধমান জেলায় দ্রষ্টব্য স্থানের কোনও অভাব নেই। আসুন এইবারের পর্বে বর্ধমানের কয়েকটি অতি প্রাচীন এবং অতি বিখ্যাত দেবী মন্দিরে আপনাদের নিয়ে যাওয়া যাক।
প্রথমে যাওয়া যাক পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলে, ঘাঘর বুড়ির মন্দিরে। ঘাঘর বুড়ি রাঢ় বাংলার একজন লৌকিক দেবী। আসানসোল শহরের উত্তর দিকে শীর্ণকায়া এক নদী আছে যার নাম নুনীয়া। এই নুনীয়া নদীর তীরে অধিষ্ঠিতা রয়েছেন জাগ্রত দেবী শ্রীশ্রী ঘাঘর বুড়ি। ঘাঘর - এই শব্দটির অর্থ হল ঝমঝম শব্দের বাজনা এবং ঘুঙুর। পুরাণে বহু দেবদেবীর আরাধনার বর্ণনায় গীত ও বাদ্যের উল্লেখ আছে। হয়ত এই দেবীকেও নাচ গানের মাধ্যমেই পুজো করা হতো। চলুন এর ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
ঘাঘর বুড়ির মন্দির বহু পুরনো; পাঁচশো বছর এর বয়স। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু কিংবদন্তি এবং অলৌকিক কাহিনী। পাঁচশো বছর আগের আসানসোল এখনকার মতো বিরাট ঝলমলে শহর তো ছিল না। সেইসময় আসানসোল জুড়ে ধূ ধূ মাঠ আর আসান গাছের জঙ্গল। (আসান গাছ এক ধরনের বড় বড় উদ্ভিদ যার ছাল বা বল্কল ফুটো করলে মিষ্টি জল বেরোয় এবং সেই জল খাওয়াও যায়। আর সল মানে রাঢ় বাংলার ডাঙা জমি। এই দুই মিলিয়েই আসানসোল নামের উৎপত্তি) এই ধূ ধূ প্রান্তরে ছোট ছোট দু একটা গ্ৰাম ছিল। তাদের জনসংখ্যা খুবই কম।
সেইরকমই এক গ্ৰামে বাস করতেন কাঙালিচরণ চক্রবর্তী নামে এক অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ। তাঁর পেশা ছিল পৌরহিত্য। এক শীতের দিনে তিনি আকুল হয়ে মা চণ্ডীর কাছে তার দারিদ্র্য দূর করার জন্য প্রার্থনা করছিলেন। এরপর ঘুমের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখেন এক বৃদ্ধা তাকে বলছেন "আমি মা ঘাঘরবুড়ি তোর কোলে তিনটি পাথর রেখে গেলাম। মাঝখানের পাথরে আমি অধিষ্ঠান করব। বাঁয়ের পাথর দেবী অন্নপূর্ণা এবং ডানদিকের পাথর স্বয়ং মহাদেব।
তুই এই তিন দেবতাকে প্রতিষ্ঠা করে পুজো কর। তোর আর দুঃখ কষ্ট থাকবে না"। ব্রাহ্মণ ঘুম ভাঙতেই দেখলেন সত্যিই তার কোলে তিনটি পাথর। সেই দিনই তিনি নুনীয়া নদীর তীরে এই তিন দেবতাকে প্রতিষ্ঠা করে তাঁদের পুজো শুরু করলেন। দিনটি ছিল ১৬২০ সালের ১লা মাঘ। সেই থেকে প্রত্যেক বছর মাঘ মাসের প্রথম দিন ঘাঘরবুড়ির পূজা উপলক্ষে বিরাট উৎসব হয়।
ইতিহাস বলছে বহু প্রাচীন সময় থেকে গাছতলাতেই আচ্ছাদনবিহীন অবস্থায় পুজো হয়ে এসেছে মা ঘাঘরবুড়ির। বর্তমানে সুন্দর মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো সেই তিনটি পাথরকেই পুজো করা হয়। ঘাঘর বুড়িকে শ্রী শ্রী দেবী চণ্ডী রূপে আরাধনা করেন ভক্তরা। অতীতে হয়ত গীত-নৃত্য-বাদ্য সহ দেবী মায়ের পূজা হতো তাইই হয়ত এমন নামকরণ। আবার ঘাঘর শব্দের অন্য আরেকটি অর্থ হল নদী। নুনীয়া নদীর তীরে দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেও এই দেবী মায়ের নাম ঘাঘর বুড়ি হতে পারে।
প্রতি দিনই এখানে বহু ভক্ত সমাগম হয়ে থাকে। অমাবস্যা এবং কালীপুজোর সময়ে তা বহুলাংশে বেড়ে যায়। আর পয়লা মাঘের উৎসবে তো পুজো দিতে আসা ভক্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে লক্ষের পথে পা বাড়ায়। ঘাঘর বুড়ি নাকি কাউকে খালি হাতে ফেরান না। পাঠক বন্ধুরা, আজকের জেলা পর্ব ঘাঘর বুড়িমা ছাড়াও বর্ধমান জেলার আরো দুটি বিখ্যাত মন্দির নিয়ে লেখা যাক। বর্ধমান জেলারই অন্যতম বিখ্যাত পীঠ দেবী যোগাদ্যা মায়ের থান এবং দেবী কল্যানেশ্বরীর মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা জানানো যাক।
আসানসোল শহরের কাছে বরাকর নদীর ধারে অতি জাগ্ৰত দেবী কল্যানেশ্বরীর মন্দির। কল্যাণেশ্বরীকেও মা চণ্ডীরই একটি রূপ বলে মনে করা হয়। কিংবদন্তি রয়েছে যে রাজা বল্লালসেন এই দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে প্রায় বারোশো বছর আগের কথা। বল্লালসেন তখন বাংলার রাজা। সেসময় নাকি দেবদাস চট্টোপাধ্যায় নামে এক ব্রাহ্মণ এই অঞ্চলে আসেন।
এই দেবদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তন্ত্রসাধক। মা কালীর সাধনা করার জন্য এখানে এসেছিলেন তিনি। সেই সময় এই এলাকা ছিল ঘন জঙ্গল-পরিবৃত। কথিত, রাজা বল্লাল সেন ছিলেন এই কাপালিকের ভক্ত। এই ব্রাহ্মণের নির্দেশ মতো বল্লালসেন পশ্চিম বর্ধমানের কুলটির কাছে শ্রবণপুরে মা কল্যাণেশ্বরীর মন্দির স্থাপন করেন। তখন নাকি দেবী শ্যামা রূপে পূজিতা হতেন। পরবর্তী সময়ে সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। এত লোকজনের কোলাহলে বিরক্ত হয়ে দেবী নাকি শ্রবণপুর ছেড়ে বর্তমান মন্দির যেখানে, সেইখানে একফুট গভীর এক গর্তে আশ্রয় নেন। সেই থেকেই এখানে তাঁর আরাধনা করা হচ্ছে। দেবী কল্যাণেশ্বরীর নামেই পরবর্তী সময়ে এই স্থানের মাইথন নামটি প্রচলিত হয়। মাই কা থান, (মায়ের ঘর) সেখান থেকেই ছোট হয়ে মাইথন নামের প্রচলন হয়।
কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে কোনও মূর্তির পূজা করা হয় না। এখানে একটি বড় পাথর রয়েছে। পাথরের এক কোনায় একটি গর্ত রয়েছে। দেবীর ভক্তরা বিশ্বাস করেন ওই গর্ত ছুঁলেই দেবী আশীর্বাদ করবেন। এই বিশ্বাসেই গত ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে জেলা বা রাজ্য তো বটেই, দেশেরও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমন কি দেশের বাইরে থেকেও কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়ে আসছেন ভক্তরা। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবীর কাছে কিছু চাইলে মা কখনো ফেরান না। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে বর্তমানে বিশেষ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। পশ্চিম বর্ধমান তো বটেই গোটা পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে মাইথন এবং মা কল্যাণেশ্বরী মন্দির বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে।
এবার যাওয়া যাক দেবী যোগাদ্যার থানে। পূর্ব বর্ধমান জেলার ক্ষীরগ্ৰামে দেবী যোগাদ্যার মন্দির। দেবী যোগাদ্যার থান কিন্তু একান্ন সতীপীঠের একটি সতীপীঠ। পুরাণের উপাখ্যান অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করলে মহাদেব মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য করতে থাকলে নারায়ণ সতীর দেহ তাঁর চক্র দিয়ে একান্ন খণ্ডে ছেদ করেন ৷ সতীর মৃতদেহের সেই একান্ন খণ্ড একান্নটি স্থানে পতিত হয় ৷ এই একান্নটি জায়গা সতীপীঠ রূপে পরিচিত। ক্ষীরগ্রামও এমন এক সতীপীঠ যেখানে সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল। এই দেবী যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন স্বয়ং কবি কৃত্তিবাস ওঝা। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী রামচন্দ্র মহীরাবণ নামের এক অসুরকে বধ করার জন্য দেবীকে আহ্বান করে এনেছিলেন।
ক্ষীরগ্রামের পশ্চিমে রয়েছে দেবী যোগাদ্যার মন্দির। দেবী সেখানে সিংহপৃষ্ঠে আসীন দশভুজা মহিষমর্দিনী। কালো কোষ্ঠীপাথরে তৈরি তাঁর মূর্তি। মন্দির লাগোয়া ক্ষীরদিঘির জলে দেবীর বাস অর্থাৎ বছরে মাত্র ৬ দিন দেবী জল থেকে ডাঙায় ওঠেন এবং অন্য দিনগুলোতে মন্দির লাগোয়া দিঘীতে দেবীর মূর্তি ডুবনো থাকে। কিন্তু এই ছদিনের মধ্যে মাত্র দু’ দিন ভক্তরা দেবীর দর্শন পান - বৈশাখ মাসের সংক্রান্তির আগের দিন এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের চার তারিখে। এখানে দেবীর ভৈরব হলেন ক্ষীরকন্ঠ মহাদেব। তন্ত্রচূড়ামণি মতে এই দেবী যেখানে অধিষ্ঠিত, সেখানে আর কোনও দেবীর মূর্তি রাখা যায় না বা পুজো আরাধনাও করা যায় না। দেবীকে প্রতিদিন আমিষ ভোগ নিবেদন হয়। কালী পুজোর রাতে মা যোগাদ্যার মহাভোগই দেওয়া হয় দেবী কালীকে। অত্যন্ত জাগ্ৰত এই দেবীকে দর্শন এবং পূজা দেওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ আসেন।
পাঠকবন্ধুরা, বর্ধমান জেলা পর্ব এবার দেবী আরাধনাতেই শেষ করা যাক। পরের পর্বে আসবে বর্ধমান জেলার আরো নতুন নতুন তথ্য।