বর্ধমান এমন একটি বর্ধিষ্ণু জেলা যার তুলনা সে নিজেই। বৃহৎ শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প অথবা কৃষি - সবদিকেই বর্ধমান জেলা সমৃদ্ধ। বাংলার প্রথম লৌহ ইস্পাত শিল্প গড়ে উঠেছিল পশ্চিম বর্ধমানের কুলটিতে। আর দুর্গাপুর, আসানসোল, বার্নপুর, রাণীগঞ্জ - এই অঞ্চল তো শিল্পাঞ্চল হিসেবেই পরিচিত।
জার্মানির "রূর (Rhur)" শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করে এবং তার সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে দুর্গাপুরকে ‘ভারতের রূর’ বলা হয় একথা তো আমরা ভূগোল বইতে সবাই পড়েছি। জেলা সদর বর্ধমান থেকে অল্প দূরে কাঞ্চন নগর ছুরি, কাচির জন্য প্রসিদ্ধ। বর্ধমান জেলার ধাত্রিগ্রামও তাঁতের কাপড়ের জন্য প্রসিদ্ধ। আর কৃষিজ সমৃদ্ধির দিক দিয়ে বর্ধমান জেলা সত্যিই "বর্ধমান"।
এবার বর্ধমান জেলার গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য স্থানগুলি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। এই জেলাতে দেখার জায়গা বা বেড়ানোর জায়গার কোনো অভাব নেই। প্রথমে বর্ধমান শহরের প্রসিদ্ধ দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে যাওয়া যাক।
এই প্রাচীন নগর জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন স্থাপত্য। রয়েছে প্রাচীন মন্দির, প্রাচীন মূর্তিও।
প্রথমেই যাওয়া যাক বর্ধমান রাজবাড়িতে। এই অপূর্ব সুন্দর প্রাসাদটি এখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ভবন রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এরপর যাওয়া যেতে পারে টাউন হলে। ১৮৯০-৯৪ সালের মধ্যে নির্মিত হয় বর্ধমান টাউন হল। ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করানো এই বিল্ডিং অত্যন্ত নয়নাভিরাম। ২৪০০ বর্গফুটের এই টাউনহলে ৫০০ জনের বসার জায়গা রয়েছে।
টাউনহলের পাশেই রয়েছে কার্জন গেট। রাজা বিজয় চাঁদ মহাতাবের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে, বর্ধমানের মহারাজা ১৯০৩ সালে জিটি রোড এবং বিসি রোডের সংযোগস্থলে এই বিশাল তোরণটি তৈরি করেছিলেন। ১৯০৪ সালে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সফরের সময় তোরণটির নাম রাখা হয়েছিল “কার্জন গেট”। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এর নামকরণ করা হয় “বিজয় তোরণ”।
বর্ধমানের অন্যতম বিখ্যাত মন্দির হল সর্বমঙ্গলা মন্দির। ১৭০২ সালে মহারাজা কীর্তিচাঁদ এই সর্বমঙ্গলা মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই মন্দির বর্ধমানের ডিএন সরকার রোডে অবস্থিত। দেবী সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো। ন'টি চূড়াবিশিষ্ট এই মন্দিরটি অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন মন্দির।
বর্ধমান জেলার দ্বিতীয় নবরত্ন মন্দিরটি রয়েছে পূর্ব বর্ধমানের কাঞ্চননগরে। এই মন্দির ঘিরে জড়িয়ে রয়েছে নানা কাহিনি। দু'হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন মন্দিরের দেবীমূর্তিটি। শিবের নাভি থেকে বেরিয়ে আসা পদ্মের উপর বিরাজমানা দেবী মা কঙ্কালেশ্বরী এখানে অষ্টভূজা। পূর্ব বর্ধমানের এই মন্দির নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা লোকগাথা।
দক্ষিণবঙ্গের প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম প্রাচীন এই কঙ্কালেশ্বরী মন্দির। কথিত কাহিনী বলছে যে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে দামোদরের তীর থেকে সাধক পরিব্রাজক কমলানন্দ স্বপাদেশ পেয়ে দেবী কঙ্কালেশ্বরীর মূর্তি নিয়ে এসে কাঞ্চনগড়ের এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এই মূর্তি বৌদ্ধ বা পাল যুগের হতে পারে। এই দেবী মূর্তি দু হাজার বছরের বেশি প্রাচীন। প্রায় সারাবছরই এখানে ভিড় থাকে ভক্তদের। আর কালীপুজোর সময় তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত থাকে না।
মন্দির ছাড়াও, বর্ধমান ১৯ শতকের গোড়ার দিকে খ্রিস্টান চার্চ তৈরি হয়। বিজয় তোরণের কাছে এই ক্যাথলিক চার্চটি অবস্থিত। লাল ইট দিয়ে তৈরি গির্জাটি ১৮১৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন চার্লস স্টুয়ার্টের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল।
একটু অন্যরকম একটা জায়গায় যাওয়া যেতে পারে। রমনাবাগান জুলজিক্যাল পার্ক -
এটি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাপবাগ ক্যাম্পাসের কাছে অবস্থিত। এই পার্কে প্রচুর হরিণ রয়েছে। এলাকাটি প্রায় ১৪ হেক্টর। চিতাবাঘ, ভাল্লুক, কুমির, দাগযুক্ত হরিণ ছাড়া বেশ কিছু নানাধরনের পাখিও সেখানে রাখা হয়েছে। এটি পশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগ দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
বর্ধমান জেলার গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য স্থানগুলি নিয়ে পরের পর্বে আবার আসব। পাঠকবন্ধুদের কেমন লাগছে বর্ধমান জেলা কথা?