আজ জেলা পর্ব লিখতে শুরু করেই মনে হল এই মাসেই তো আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক নায়ক জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন এই বর্ধমান জেলাতেই। শুধু একজনই বা কেন, বর্ধমানে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত মানুষের সংখ্যা তো কম নয়। তাদের অনেকের নাম আমাদের অজানা কিন্তু তারাই সারা দেশে বা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে তাদের কাজের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের নাম উজ্জ্বল করছেন। তাঁরা প্রত্যেকে সম্মাননীয়। কিন্তু এখানে সীমাবদ্ধ পরিসরে তো সবার নাম লেখা সম্ভব নয়। তাই জানা অজানা বর্ধমান জেলার সমস্ত উজ্জ্বল নক্ষত্রদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে আজকের পর্বে লিখছি কয়েকজন বিখ্যাত মানুষের কথা যারা "শরিফাবাদ"-এ জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন।
বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই মহানায়কের নাম রাসবিহারী বসু। রাসবিহারী বসুর জন্ম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্ৰামে। গদর বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক এই অগ্নিপুরুষের নাম ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। এই মহান বিপ্লবীই ভারতের বাইরে সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন ও পরবর্তীকালে নেতাজির হাতে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর পরিচালনভার তুলে দিয়েছিলেন৷
বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্ৰামে জন্ম হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের। তিনি ছিলেন গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক। তার কবিতা ও গান আজও সমানভাবে সমাদৃত। তার রচনায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনের কারণে তাঁকে "বিদ্রোহী কবি" বলা হয়ে থাকে। তার কবিতায় বারবার সোচ্চারে প্রতিবাদ করেছেন মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে। হিন্দুত্ব বা ইসলাম নয়, ধর্মীয় সংকীর্ণতার অনেক উপরে উঠে তিনি তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর রচনায়।
এবার বর্ধমানের যে মানুষের কথা লিখব তিনি আবিষ্কার করেছিলেন এমন একটি অসুখের প্রতিষেধকের যে অসুখে গত তিন শতাব্দী ধরে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। অসুখটি ছিল কালাজ্বর যে অসুখে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল আবোলতাবোল শ্রষ্টা সুকুমার রায়ের। এই জ্ঞানতাপস বিজ্ঞানী চিকিৎসকের নাম উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী।
কালাজ্বরের টিকা ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনার পূর্বস্থলীর বাসিন্দা বিজ্ঞানী স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী নাইট উপাধি লাভ করেন। এমনকি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তাকে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়েছিল। চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর অবদান তাঁকে অমর করে রেখেছে। ভারতের প্রথম ব্লাডব্যাংকও তিনিই স্থাপন করেছিলেন।
এ ছাড়াও বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের এক প্রধান কাণ্ডারী বদরুদ্দীন উমর।
বর্ধমানের অধিবাসী ছিলেন বা জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন এমন বিখ্যাত মানুষের তালিকা লেখা শুরু করলে হয়তো শেষই হবে না। তবে কিছু বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম উল্লেখ করা যেতে পারে - যেমন, শ্রীচৈতন্যদেবের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং সহপাঠী বিখ্যাত নৈয়ায়িক/ দার্শনিক শ্রী রঘুনাথ শিরোমণি অবিভক্ত বর্ধমান জেলার মানকরের কোটা গ্ৰামে জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম দুই শ্রেষ্ঠ ভক্ত রূপ গোস্বামী এবং সনাতন গোস্বামীও বর্ধমান জেলার মানুষ ছিলেন।
চণ্ডীমঙ্গলের রচয়িতা কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বাংলায় মহাভারতের প্রথম অনুবাদক কাশিরাম দাস, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্ৰন্থের রচনাকার শ্রীবৃন্দাবন দাস, লেখক/কবি/ নাট্যকার রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত, কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক - এরা প্রত্যেকেই বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
গুরুত্বপূর্ণ বা বিখ্যাত মানুষের তো অভাব নেই এই জেলায়। পরে আবার কখনো আরো বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা যাবে।
এবার আসা যাক বর্ধমান জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কিছু কথায়। এর আগের দুটি পর্বে লিখেছিলাম যে লেখাপড়ায় সাফল্যের দিক দিয়েও এই জেলার নাম একেবারে প্রথম দিকে আসে। এবারের আলোচ্য প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন নাম ছিল রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, দুর্গাপুর। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের অন্যতম প্রাচীন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলা তথা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সরকারি প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে নাম N. I. T (National Institute of Technology) Durgapur, West Burdwan district, West Bengal. এখানকার ছাত্ররা পাণ্ডিত্যে, গবেষণায় এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারে তাঁদের কৃতিত্বের উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে চলেছেন।
বর্ধমান জেলার এবারের পর্ব এখনকার মতো শেষ করা যাক। পরের সপ্তাহে আবার নতুন একটা পর্ব নিয়ে আসব আপনাদের জন্য।