জেলার নাম বর্ধমান - পর্ব ১

রাঙামাটির জেলা বীরভূমে তো অনেক দিন হাঁটাহাঁটি করলাম, বেড়ালাম, কত নতুন তথ্য জানলাম, সমৃদ্ধ হলাম। রবিঠাকুরের প্রাণের জেলা থেকে গত রবিবার বিদায় নিয়েছি আমরা। এবার যাব তার কাছাকাছিই ... সেই জেলায় যেটা কিনা বেড়েই চলেছে। মানে সেই জেলাটার নামের আক্ষরিক অর্থ কিন্তু তাইই। পাঠক বন্ধুরা বুঝে ফেলেছেন আমি কোন জেলার কথা বলছি। ঠিকই ধরেছেন; আমরা এবার যাব বর্ধমান জেলায়। কিন্তু, বর্ধমান যে এখন আর অখণ্ড বর্ধমান নেই।

শাসনকার্যের সুবিধার জন্য আমাদের বঙ্গভূমির সরকার যে তাকে দুটো ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে - পূর্ব বর্ধমান আর পশ্চিম বর্ধমান। কিন্তু, এই বর্ধমান যখন তৈরি হয়েছিল তখনকার শাসকরা তো আর জানতেন না যে কয়েকশো বছর পরে সেই ভূখণ্ডকে বিভক্ত ফেলা হবে। তাহলে? তাহলে আমরা বরং একটা কাজ করি। জেলার ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনা করব তখন দুটো বর্ধমান মিলিয়েই তাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করি। পরে আমরা নাহয় দুটো ভাগে আলাদা আলাদা ভাবে বেড়াব। আরে গুপি বাঘার জুতো পরে যেতে তো এক মুহূর্ত। অসুবিধা কোথায়? তাহলে, শুরু হোক বর্ধমান (পূর্ব + পশ্চিম) জেলার কথা... প্রথমে জেলার ভূগোল নিয়ে কয়েকটি তথ্য:

অবিভক্ত বর্ধমান জেলা ছিল পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে বড় জেলা। অতি উন্নত মানের পলি মাটি দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণে বর্ধমান জেলা কৃষির দিক দিয়ে অত্যন্ত উন্নত। মূলত কৃষি প্রধান জেলা বলে এই জেলাকে পশ্চিম বঙ্গের শস্য ভাণ্ডার বলা হয়। বর্ধমান জেলার বৃহত্তম শহর বর্ধমান । ধান এই জেলার প্রধান ফসল। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ এপ্রিল এই জেলা বিভক্ত হয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলা ও পশ্চিম বর্ধমান জেলা গঠিত হয়। বর্ধমান জেলার উল্লেখযোগ্য নদীগুলি হলো প্রধানতঃ দামোদর, ভাগিরথী, অজয়।

তাদের শাখানদী ও উপনদীরা হলো সিঙ্গারাম, কুকুয়া, কুনুর, তুমুনি, খড়ি, বাঁকা, চন্দ-কাঙ্কি নালা, বেহুলা, গাঙ্গুর, ব্রাহ্মণী, খন্দেশ্বরী, করুলিয়া নালা, বাবলা, কইয়া নালা, কন্দারকাহাল, কানাদামোদর, কানানদী, ঘিয়া, কাকিনদী ইত্যাদি। কত সুন্দর আর অদ্ভুত ধরনের নাম তাই না? এরা ছাড়াও দুই বর্ধমান জুড়ে অজস্র দিঘী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদি রয়েছে। শুধু দামোদর উপত্যকা অঞ্চলে প্রায় ১৭০০০ টি পুষ্করিণী ও দিঘি রয়েছে।

Burdwan1

কৃষিজ সম্পদ ছাড়াও এই জেলার
উদ্ভিদগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিমুল, নিম,আমলকি, আম,জাম, নারকেল, খেজুর, তাল, বট, অশ্বত্থ, পলাশ, কৃষ্ণচুড়া, আমড়া , পেয়ারা, ডুমুর, বাবলা, ঘেঁটু ,গুলঞ্চ, তুলসী, এবং বিভিন্ন প্রকার ফুলের গাছ।

নানারকম পাখি এবং পশুও আছে এই দুই জেলায়ই। তার মধ্যে অন্যতম হলো হায়না, নেকড়ে এবং বুনো শূকর। প্রচুর গাছপালা এবং জলাশয় থাকার কারণে বিভিন্ন পাখিরও দেখা পাওয়া যায়। কি অপরূপ সুন্দর নাম এবং রূপ তাদের!--সোনালী হারিয়া পাখি, লালপুচ্ছ বুলবুল, লাল সিপাহী বুলবুল, লাল দাগযুক্ত ব্লুথ্রোট, বাদামী-পুচ্ছ রবিন, শ্যামা, ফ্লাই ক্যাচার, কাঠ-চিল, কালো ফিঙে, বাবুই, স্ট্রাইপড ফ্যানটাইল ওয়ার্বেলার, সোনালি ওরিওল, সাধারণ ময়না, চাতক, সাদা পুচ্ছযুক্ত মুনিয়া, সাদা গলা মুনিয়া, থুতুয়া মুনিয়া, লাল মুনিয়া, হলুদ-গলা চড়ুই আরো আরো কত.... পূর্ব বর্ধমানের নিম্ন-জলাভূমির জলাশয়গুলি শীতের পরিযায়ী পাখিদের খুব ভাল আবাসস্থল।

এ তো গেল জীব এবং উদ্ভিদ বৈচিত্রের কথা। এবার একটু পুরনো দিনের কথা আলোচনা করব। বর্ধমানের ইতিহাস বহু বহু পুরানো। এর শুরু খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ সন তথা মেসোলিথিক বা প্রস্তর যুগের শেষ দিকে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে বর্ধমানের উল্লেখ আছে। পূর্ব বর্ধমান জেলার গলসি থানা সংলগ্ন "মল্লসরুল" গ্রামে পাওয়া ষষ্ঠ শতকের একটি তাম্রলিপিতে প্রথম বর্ধমান নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু কীভাবে এই জেলার নাম "বর্ধমান" হয়েছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের দুটি মত রয়েছে। প্রথম মতানুযায়ী, ২৪ তম জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমানস্বামী'র নামানুসারে জেলার রাখা হয়েছে। জৈন কল্পসূত্রাণুসারে, মহাবীর এই অঞ্চলের

আস্তিকনগরগ্রামে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন। এই আস্তিকনগরই পরে বর্ধমান নামে পরিচিত হয়। অন্য মতটি জানাচ্ছে "বর্ধমানা" অর্থ সম্পন্ন কেন্দ্র। গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর্য সভ্যতার বিকাশের সময়ে উন্নতি এবং শ্রীবৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে স্থানটি পরিচিত ছিল। সেই উন্নতি এবং সম্পন্নতার কারণেই এই স্থানের নাম হয় বর্ধমান।

বন্ধুরা, আজ এই পর্যন্তই থাক। বর্ধমান জেলা নিয়ে লিখলে সেটাও যে "বর্ধমান"ই হবে তাতে আর সন্দেহ কী? অনেক লেখা, অনেক ঘোরা বাকি আছে পাঠকবন্ধু। আসব আবার...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...