জেলার নাম বর্ধমান – পর্ব ৪

বর্ধমান জেলা(পূর্ব বর্ধমান+পশ্চিম বর্ধমান), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এক অন্যতম সমৃদ্ধ জেলা। কৃষি ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে এই জেলাটি অত্যন্ত উন্নত। ভাগীরথী নদীর পাললিক মৃত্তিকার এক বিশাল অংশ নিয়ে এর পূ্র্ব অংশ গঠিত এবং এই অংশটি কৃষির জন্য প্রসিদ্ধ। পশ্চিম অংশের সদর শহর আসানসোল; এই অংশটি(বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান জেলা) কয়লাখনি ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এটি বৃহৎ শিল্পের দিক দিয়ে খুবই উন্নত। ইস্পাত, সিমেন্ট ও লৌহের উপর ভিত্তি করে এখানে অনেক বড় মাপের শিল্প গড়ে উঠেছে। বেশ কিছু শহর যেমন দুর্গাপুর, কুলটি ও বার্নপুর হল খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল। তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র ডিসেরগড় ও দুর্গাপুরে এবং দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট দুর্গাপুরে অবস্থিত। খনিজ সম্পদও এই জেলাকে সমৃদ্ধ করেছে।

medi 2

এবার বর্ধমানের(পূর্ব)অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কিছু তথ্য আলোচনা করা যাক।

রাঢ়বঙ্গের বহু প্রাচীন জনপদ বর্ধমান। এখানকার রাজ পরিবার নিয়ে নানা কাহিনী মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত; অত্যন্ত আধুনিক মনস্ক ছিলেন বর্ধমানের রাজারা। যার ছাপ রয়ে গিয়েছে শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্কুল, কলেজ, অন্যান্য নয়নমনোহর স্থাপত্যে। কিছুটা এই ধারণা আছে মানুষের যে বর্ধমানের রাজা বা রানীরা অনেকগুলো মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু মন্দির নয়, বর্ধমানের রাজারা তৈরি করিয়েছিলেন স্কুল, কলেজ, উদ্যান, বড় বড় সুন্দর কারুকার্যময় বিল্ডিং, লাইব্রেরী, হাসপাতাল এবং হয়তো তাঁদের সবথেকে বড়ো অবদান...একটি বিশ্বমানের মেডিক্যাল কলেজ - বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ।

সময়টা গত শতাব্দীর গোড়ার দিক। ভারতবর্ষে চলছে তখন ব্রিটিশদের শাসন। সেই সময় বর্ধমান এস্টেটের মহারাজাধিরাজ বিজয়চাঁদ মহতাব। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরিবর্তে রাজ পরিবার চেয়েছিল, প্রজাদের স্বার্থ যাতে কোনও ভাবে ক্ষুণ্ণ না হয়, পাশাপাশি নিজেদের আধিপত্যও যাতে বজায় থাকে। এমন একজন রাজাকে নিজেদের সমস্যার কথা প্রজারা বলতে পারতেন নির্দ্বিধায়। বর্ধমান শহরে তখন সুন্দর সুন্দর স্থাপত্য নির্মিত হচ্ছে, সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে, অথচ এই জেলায় বা শহরে উন্নতমানের দূরে থাক, সাধারণ চিকিৎসারও বিশেষ সুযোগ নেই। তাই নিজেদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল তৈরির ব্যাপারে বর্ধমানের বাসিন্দারা প্রথম অনুরোধ করেন রাজামশাইকে।

কলকাতায় সেইসময় তিনটি মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়ে গিয়েছে। ঘরের দুয়ারে চলে এসেছে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। বর্ধমানের অধিবাসীরা দাবি তোলেন শহরে একটি আধুনিক হাসপাতাল চাই। প্রজাদের দাবি গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব। হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু হল। ১৯১০ সালের ৯ নভেম্বর চালু হল একশো সাতাশ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল; নাম ফ্রেজার হাসপাতাল। এর এগারো বছর পর ১৯২১ সালে বর্ধমানে শুরু হল মেডিক্যাল স্কুল। তখন বাংলার গভর্নর ছিলেন আর্ল রোনাল্ডসে। তাঁকে সম্মান জানিয়ে সেই স্কুলের নাম রাখা হয়েছিল "রোনাল্ডসে মেডিক্যাল স্কুল"। কিন্তু দেশ ইংরেজদের শাসনমুক্ত হওয়ার পর 'ভোর কমিটি'র সুপারিশ অনুযায়ী দেশে অভিন্ন চিকিৎসাশাস্ত্র চালুর উদ্দেশ্যে ১৯৫৮ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বর্ধমানের এই মেডিক্যাল স্কুলটি।

medi 3

তবে হাসপাতালটি থেকে যায়। শুধু নাম বদলে হয়ে যায় বিজয়চাঁদ হাসপাতাল। এর বেশ কিছু দিন বাদে বর্ধমানে একটি মেডিক্যাল কলেজ তৈরির প্রস্তাব ওঠে। বিধানচন্দ্র রায় তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। প্রস্তাবে সায় দেন তিনি। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে, ব্রিটিশ আমলে ১৯১০ সালে তৈরি এই বিজয়চাঁদ হাসপাতালই হয়ে ওঠে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ১৯৬৯ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পথ চলা শুরু হয় 'বর্ধমান ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল কলেজের'। পরে ১৯৭৬ সালের ৪ অগস্ট রাজ্য সরকার কলেজটি অধিগ্রহণ করলে তার নাম হয় "বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ"। ২০০৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ হেল্থ সায়েন্সেস-এর আওতায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই মেডিকেল কলেজ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই ছিল।


পাঠকবন্ধুরা, বর্ধমান জেলা নিয়ে আরো অনেক কথা আসবে পরবর্তী পর্বগুলোতে। জেলায় জেলায় ঘুরতে ভালো লাগছে তো?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...