গত সপ্তাহে জেলা পর্ব শুরু হয়েছিল বর্ধমান জেলার ইতিহাস দিয়ে। সেই নিয়েই আরো কিছু তথ্য আলোচনা করা যাক। বর্ধমান জেলার প্রাচীন ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবের। পূর্ব বর্ধমান জেলার মশাগ্ৰাম থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময়কার মুদ্রা। এর থেকে মনে করা হয় এই অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তার পরে বর্ধমান ছিল পাল রাজাদের শাসনাধীন। পালযুগে বর্ধমান অতি সমৃদ্ধ স্থান ছিল। অনেক ঐতিহাসিকদের ধারণা পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল এই রাঢ় অঞ্চলের ভূমিপুত্র ছিলেন। বাংলায় যখন প্রথম মুসলমানরা আসে তখন এই বর্ধমানে বিদ্রোহের পর বিদ্রোহ হয়েছিল। মোঘল আমলে বর্ধমানকে বলা হত ‘সরিফাবাদ’, অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বসবাসের স্থান। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে ও বর্ধমান জেলার উল্লেখ পাওয়া গেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে মুঘল সম্রাট আকবর তাঁর শাসনকালে সমগ্র বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করেছিলেন যার মধ্যে অন্যতম সরিফাবাদের অন্তর্ভুক্ত বর্ধমান।
দিল্লির মুঘল বাদশাহদের শাসনামলে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছিল বর্ধমান। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে পাঠান বাদশা দায়ুদ কররানিকে বাংলা থেকে উড়িষ্যার দিকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলায় এসেছিলেন মুঘল সেনাপতি টোডরমল। টোডরমলের ঘাঁটি ছিল এই বর্ধমান জেলাতেই। শাহজাহান থেকে শেরশাহ, নূরজাহান থেকে শের আফগান, ফারুকশিয়র— দিল্লি থেকে বহু দূরে এই ‘সরিফাবাদ’-এ এসেছিলেন।
এই বর্ধমান জেলাতেই থাকতেন ইতিহাসখ্যাত শের আফগান যার স্ত্রীর নাম ছিল মেহেরুন্নেসা। শের আফগানের মৃত্যুর পর এই মেহেরুন্নেসাকে বিবাহ করেছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং মেহেরুন্নেসার নাম রাখেন "নূর জাহান"। এই নূরজাহানকে কিন্তু বর্ধমান জেলা থেকেই জাহাঙ্গীর দিল্লি নিয়ে গিয়েছিলেন। এই বর্ধমানেই বীর যোদ্ধা শের আফগানের সমাধি রয়েছে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বর্ধমান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করে। বর্ধমানের প্রথম মহারাজাধিরাজ ছিলেন রাজা তিলকচাঁদ । দিল্লির তৎকালীন বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে "মহারাজাধিরাজ" উপাধি লাভ করে বর্ধমানের সিংহাসনে বসেন তিনি। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং বাংলার নবাবের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দ্বিধা বোধ করেন নি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবশ্য ভালো করেই জানত যে বর্ধমান কতটা সমৃদ্ধ অঞ্চল এবং সেখানে তাদের বাণিজ্যের কুঠিগুলি সচল থাকবে শুধু মাত্র মহারাজার সহানুভূতির উপর নির্ভর করে। তাই তাঁরা রাজা তিলকচাঁদকে অসন্তুষ্ট করতে চায় নি। এই রাজবংশের অন্যতম রাজারা হলেন প্রতাপচাঁদ এবং মহতাবচাঁদ। বর্ধমানের এই রাজপরিবার থেকে মহাতাবচাঁদ, আফতাবচাঁদ, বিজয়চাঁদ ও উদয়চাঁদ - এই চার রাজা রাজত্ব পরিচালনা করেছেন।
১৯৫২ সালে জওহরলাল নেহেরুর সরকার জমিদারি উচ্ছেদ আইন আনলে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। বর্ধমান রাজবংশের বিশাল রাজত্ব সরকারের হাতে চলে যায়। ১৯৫৩ সালে মহারাজ উদয়চাঁদ বর্ধমান ছেড়ে বেনারস চলে যান। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির জন্য মহারাজ উদয়চাঁদের কাছে তাঁদের বর্ধমান শহরে অবস্থিত মহতাব মঞ্জিল ভবনটি চেয়ে নেন। ১৯৫৮ সালে বর্ধমান রাজপরিবার রাজ্য সরকারের হাতে সেই রাজবাড়ি তুলে দেয়। ১৯৬০ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন সুকুমার সেন।