নাহ্ এবার বীরভূম জেলার কথা শেষ করতেই হবে। দু মাস ধরে বীরভূম জেলায় পড়ে আছি আমরা। এবার তো অন্য জেলাগুলো অভিমান করবে। তারা এবার মনে মনে বলবে "রবি ঠাকুরের প্রিয় জেলা বলে নাহয় কিছুদিন তোমাদের বাড়তি সময় দেওয়া গেল। তাই বলে আমরা বুঝি গুরুত্বপূর্ণ নই? আমাদের নিয়ে বুঝি দু চার কথা লেখা যেতে পারে না?" কিন্তু রাঙামাটির এই জেলার আকর্ষণ কাটানো যে খুব মুশকিল। অপ্রতিরোধ্য এই জেলার টান।
তবুও তো একসময় বিদায় নিতে হয়। এই পর্ব হলো আমাদের সেই বীরভূম বিদায় পর্ব। বীরভূম জেলা নিয়ে তো কথা শেষ হওয়ার নয়। তাই শেষ পর্বেও আরো লিখে যেতে ইচ্ছে করে।
বীরভূম জেলার আরেকটি দর্শনীয় স্থান হলো দ্বারবাসিনী দেবীর মন্দির। এই জেলার মহম্মদবাজারের কাছাকাছি হিংলায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে শাল, সেগুন, মহুয়ার জঙ্গল। এই জঙ্গল দিয়ে ঘেরা দ্বারবাসিনী মায়ের মন্দির। এই মন্দির বহু পুরনো। দ্বারবাসিনী দেবীর শিলামূর্তিকে পুজো করা হয়। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দ্বারকেশ্বর নদী। এই নদীর এক পারে বীরভূম অন্য পারে ঝাড়খণ্ড জেলা।
দ্বারবাসিনী মন্দিরে বীরভূম জেলা তো বটেই ভিন্ রাজ্য থেকেও অনেক ভক্ত দর্শনার্থী পুজো দিতে আসেন। এক সময় এই দ্বারবাসিনী এলাকায় বহু হিন্দি, বাংলা সিনেমা, সিরিয়াল, টেলিফিল্মের শ্যুটিং হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র "দেবশিশু"। মা দ্বারবাসিনী দেবী দুর্গার এক রূপ। এই মন্দিরে দ্বারবাসিনী ছাড়াও লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং গণেশের পুজো হয়। দেবীকে প্রতিদিন পরমান্ন অর্থাৎ পায়েস রান্না করে নিবেদন করা হয়। মন্দিরের বাইরে একটি ছোট স্তম্ভ রয়েছে যেটার উপর বায়সপক্ষী অর্থাৎ কাককে ভোগ দেওয়া হয়। কথিত, বহু আগে এই জঙ্গলে বাঘ ছিল এবং বাঘের জন্যও দেবীর প্রসাদ মন্দিরের বাইরে দেওয়া হতো। বাঘ একসময় এসে সেই প্রসাদ খেয়ে যেত।
প্রায় হাজার দেড়েক প্রাচীন শাল, শিমুল, মহুয়া গাছের ঘন বন রয়েছে মন্দিরের চারপাশে। রয়েছে অন্যান্য নানা প্রজাতির গাছও। মকর সংক্রান্তির দিন সেই সব গাছের ফাঁকে ফাঁকে মেলা বসে। দেখে মনে হয়, মেলাটি যেন রঙে রঙে ঝিলমিল করে উঠেছে। দ্বারকা নদীর কাঁচের মত স্বচ্ছ হাঁটু জলে প্রচুর পুণ্যার্থী মকর স্নান সেরে প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন দ্বারবাসিনী দেবীর শিলা মূর্তিতে পুজো দেন।
দ্বারবাসিনী এলাকার সব গ্রামের সব শ্রেণির মানুষ ছাড়াও লাগোয়া ঝাড়খণ্ড থেকেও বহু মানুষ সেই মেলায় আসেন। দলে দলে আদিবাসীরা নাচের দল নিয়ে এসে মেলাকে মাতিয়ে তোলে। পর্যটক পুণ্যার্থীদের কাছে আদিবাসীদের ধামসা মাদলের তালে তালে এই নাচ গান একটি বিশেষ প্রাপ্তি।
বীরভূম জেলা অন্যতম বিশেষত্ব হলো এখানকার কুটির শিল্প। বৃহৎ শিল্প বিশেষ না থাকলেও বীরভূম কুটির শিল্পের একটি প্রধান কেন্দ্র। সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কুটির শিল্পকেন্দ্র হলো আমার কুটির নামে একটি অলাভজনক গ্রামীণ সংস্থা। বীরভূমের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিল্প হলো কৃষিভিত্তিক শিল্প, বস্ত্র, বনজ, শিল্প ও কারুশিল্প।
শ্রীনিকেতন তার দুগ্ধ শিল্পের জন্য এবং বনজ শিল্পকেন্দ্র হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছে। বীরভূমের কুটির শিল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিল্প হলো বয়নশিল্প বা টেক্সটাইল — বিশেষত তুলা এবং স্থানীয়ভাবে কাটানো তসর সিল্ক, পাটের কাজ, বাটিক, কাঁথা সেলাই, চামড়া, মৃৎশিল্প এবং পোড়ামাটি, কাঠ, বাঁশ এবং বেতের কারুশিল্প, ধাতুর কাজ এবং আদিবাসী কারুশিল্প। এখানে প্রায় ন হাজারের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি স্তরের শিল্প রয়েছে।
এইবার আসা যাক আমার সবথেকে প্রিয় বিষয়টিতে। শুধু আমার কেন, আমার ধারণা আমার সমস্ত পাঠকবন্ধুরাই ভারি উৎসাহিত হয়ে উঠবেন এবার। আসছি খাওয়াদাওয়ার আলোচনায়। বর্ধমানের যেমন মিহিদানা-সীতাভোগ কিংবা কৃষ্ণনগরের সরভাজা সরপুরিয়া তেমনি বীরভূমের হলো মোরব্বা। এই জেলার সদর সিউড়ি শহরের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জুড়ে গিয়েছে মোরব্বার নাম। শিউড়ি এলে প্রচুর মানুষ আম, বেল, পেঁপে, ন্যাসপাতি, আপেল, হরিতকি, আমলকী-সহ নানা বর্ণের সুস্বাদু মোরব্বার স্বাদ নিতে এবং কিনে নিয়ে যেতে ভোলেন না।
শুধু সাধারণ মানুষ নন, রাজ্যের মন্ত্রি, আমলা, যাদুকর, অভিনেতা, খেলোয়াড় থেকে সংস্কৃতি জগতের অনেক স্বনামধন্য ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাঁরা সিউড়ির মোরব্বার স্বাদে তৃপ্তি লাভ করেছেন। সিউড়িতে এসে মোরব্বা নিয়েও গিয়েছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে রয়েছেন সিনিয়ার ও জুনিয়ার পিসি সরকার, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, লালুপ্রসাদ যাদব, অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমারের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও। এমনকী মহানায়ক উত্তমকুমারের জন্যও সিউড়ি থেকে বিশেষ ভাবে তৈরি মোরব্বা যেত কলকাতায়।
তবে শুধু মোরব্বা কেন, আম, লেবু, তেঁতুল, আদা, লঙ্কা, ওল, আমড়া, জলপাই চালতা-সহ নানান রকম আচারও সিউড়িতে এখন সমান জনপ্রিয়। আহা শুনলেই জিভে জল চলে আসে না!
নাহ্ এবারের মতো বিদায় নিতেই হচ্ছে রাঙামাটির জেলা থেকে। রবিঠাকুরের প্রাণের জেলা থেকে তারই একটা গান গেয়ে এবার চলা যাক নতুন পথে, নতুন জেলায়।
"তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।
এসো গন্ধে বরনে, এসো গানে।
এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে,
এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে
এসো মুগ্ধ মুদিত দু নয়ানে।
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।
এসো নির্মল উজ্জ্বল কান্ত,
এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত,
এসো এসো হে বিচিত্র বিধানে।"