জেলার নাম বীরভূম - পর্ব ৮

গত দুই পর্বে লিখেছিলাম.. বলা ভালো পাঠকবন্ধুদের সঙ্গে আমি মনে মনে বেড়াতে গিয়েছিলাম বীরভূম জেলার শক্তিপীঠগুলিতে‌। আজ যাব আমরা সেই বীরভূমেরই এক মহাপীঠ.... তারাপীঠে।

বীরভূম জেলার রামপুরহাট স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই ছোট্ট গ্ৰাম তারাপীঠ। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী তারা মায়ের নামেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে। বীরভূম জেলার অন্যতম নদী দ্বারকেশ্বর এই গ্ৰামের গা দিয়ে বয়ে চলেছে। তন্ত্রসাধনার মহাপীঠ বলা হয় তারাপীঠকে। মনে করা হয় তারাপীঠে কোনো সাধক সাধনা করে যদি সিদ্ধি লাভ করেন তাহলে তিনি অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হন।

তারাপীঠে রয়েছে মা তারার মন্দির। মন্দিরের স্থাপত্য শতাব্দী প্রাচীন। এই তন্ত্রসাধনার মহাস্থান বহু বহু পুরানো। কিন্তু বর্তমান মন্দিরটির বয়স দুশোর কিছু বেশি। মনে করা হয় যে এই মন্দিরের জায়গাতেই পুরনো মন্দির ছিল কিন্তু দ্বারকেশ্বরের বন্যায় সেটি ধ্বংস হয়ে যায়।

১৮০৮ সালে (১২২৫ বঙ্গাব্দে) মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে নতুন মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। ঐ বছরের ৮ই এপ্রিল (মতান্তরে ১৫ই এপ্রিল) জনসাধারণের জন্য মন্দির দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরে মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব নেন নাটোরের রানী ভবানী। বর্তমান মন্দিরটির স্থাপত্য শৈলী সম্পূর্ণ বাংলার নিজস্ব। টেরাকোটা শিল্পের ছাপ আছে এই মন্দিরের গায়ে এবং দেবীর ভৈরব চন্দ্রচূড় শিবের মন্দিরেও।

BirbhumPartVIII1

তারাপীঠ মূলতঃ সাধক বামদেব বা বামাক্ষ্যাপার সাধনক্ষেত্র রূপেই বিখ্যাত। কিন্তু প্রচলিত আছে যে তারও বহু পূর্বেই এই ধাম ছিল বশিষ্ঠমুনির সাধনার স্থান। বামাক্ষ্যাপার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে।

মন্দির এবং স্বয়ং দেবী তারার মূর্তির সাথেও বহু অলৌকিক কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে। অনেকের মতে এটি একান্ন সতীপীঠের একটি। এখানে দেবীর তৃতীয় নয়নের তারা পড়েছিল। কিন্তু এই কথার স্বপক্ষে কোনো প্রামাণ্য তথ্য কোনো পুরাণে বা পুঁথিতে পাওয়া যায় নি।

কোনো মন্দিরে বা স্থাপত্যে কখনো নির্মাণ শ্রমিকদের নাম থাকে না কিন্তু তারাপীঠ মন্দিরের গায়ে মন্দিরের নির্মাণ শ্রমিকদের নামের ফলক লাগানো রয়েছে। মন্দির এলাকায় অমৃতকুণ্ড নামে একটি পুকুর রয়েছে। ভক্তদের বিশ্বাস এই পুকুরে স্নান করলে সব রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং দেবী তারাকে আরাধনা করলে সব মনোবাসনা পূর্ণ হয়।

মন্দিরের ভিতরে মা তারার শিলামূর্তি স্থাপিত রয়েছে। শিলামূর্তিটি যাতে নষ্ট না হয় যায় তাই মূর্তিটি ধাতব আবরণের একটি কালিমূর্তি দিয়ে ঢাকা থাকে। ভক্ত দর্শনার্থীরা এই রূপার আবরণে ঢাকা মূর্তিই দর্শন করেন। মা তারার গলায় মুণ্ডমালা এবং রক্তমাখা জিহ্বা। মাথায় রূপোর মুকুট। তার উপর রুপোর ছাতা।

মূর্তিটি বস্ত্র পরিহিতা এবং জবা, গাঁদা ও নীল অপরাজিতার মালায় সজ্জিতা। কপালে লাল বা মেটে সিঁদুর পুরু করে লাগানো থাকে। ভক্তদের কপালে এই সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দেওয়া হয়। এই ধাতব মূর্তির নীচে আছে তারা মায়ের শিলামূর্তি। শুধু স্নানের সময় ধাতব মূর্তির আবরণ সরিয়ে শিলামূর্তিটি বের করা হয়।

BirbhumPartVIII2

প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন তারা মায়ের দর্শন করে পুজো দেওয়ার জন্য। অমাবস্যা তিথিতে এই দর্শনার্থী সংখ্যা লক্ষ ছুঁয়ে যায়। শুধু বীরভূম জেলা বা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নয়, সারা দেশ এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দু পুণ্যার্থীরা আসেন তারাপীঠে অত্যন্ত জাগ্ৰত দেবী তারা মায়ের টানে।

তারাপীঠ মন্দিরের কাছেই আছে মহাশ্মশান। আগে এই শ্মশান ছিল ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। শিয়াল, খট্টাস প্রভৃতি প্রাণীর বাস ছিল এখানে। আর তন্ত্রসাধক যোগীদের সাধনস্থল ছিল এই মহাশ্মশান। এখানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন স্বয়ং বামাক্ষ্যাপা। এই মহাশ্মশানে বামাক্ষ্যাপার সমাধি মন্দির ও তারা মায়ের পায়ের ছাপ রয়েছে। বামাক্ষ্যাপা এবং তারা মা'কে নিয়ে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। কতোটা তার সত্যি এই বিচারে না গিয়েও বলা যায় "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর"..

আজ এটুকু থাক। পরের সপ্তাহে বীরভূমের শেষ পর্ব লিখি? পাঠক বন্ধুরা, সবাই ভালো থাকুন কিন্তু...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...