গত সপ্তাহের জেলা পর্বে বাকি থাকা বীরভূম জেলার দুটি সতীপীঠ নিয়ে এই পর্বে কিছু তথ্য জানানো যাক..। গত পর্বে লিখেছিলাম কঙ্কালীতলার দেবী দেবগর্ভা এবং নলহাটির দেবী নলাটেশ্বরীকে নিয়ে। বাকি আর দুটি পীঠস্থান হল সাঁইথিয়ায় মা নন্দিকেশ্বরীর মন্দির এবং লাভপুরে দেবী ফুল্লরার মন্দির।
প্রথমে যাই দেবী নন্দিকেশ্বরীর থানে। তন্ত্রচূড়ামণি গ্ৰন্থে নন্দিকেশ্বরী মূল পীঠ রূপে ধরা হয়। এই গ্রন্থে নন্দিকেশ্বরীকে পঞ্চাশৎ পীঠ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। বীরভূমের সাঁইথিয়া শহরের মোটামুটি মাঝখানে অবস্থিত নন্দীকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে কিংবদন্তী কিছু কম নেই। পুরাণে উল্লিখিত আছে যে দক্ষযজ্ঞের পর দেবীর কণ্ঠহাড় নাকি এখানে পড়েছিল। এক বিশাল বটগাছ ছাতার মত ঘিরে রেখেছে এই নন্দিকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গনটিকে।
কথিত, এই বটগাছের নীচেই দেবী নন্দিকেশ্বরীর অবস্থান। শোনা যায়, দেবী নিজেই স্বপ্ন দিয়ে তাঁর অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন দাতারাম ঘোষ নামে এক ভবঘুরে মানুষকে। দাতারাম দক্ষিণেশ্বরের অধিবাসী হয়েও ভাগ্য অন্বেষণে বীরভূমে চলে এসেছিলেন। এখানে এক সাহেবের কৃপা লাভ করে তার ভাগ্য ফিরে গিয়েছিল। তিনি পরে দেওয়ান হওয়া থেকে শুরু করে জমিদারি কিনে জমিদার হয়েছিলেন। এরপর থেকেই দেবী নন্দিকেশ্বরীর পুজোর প্রচলন করেন তিনি।
দেবী নন্দিকেশ্বরীর নামেই একসময় সাঁইথিয়া শহরের নাম ছিল নন্দীপুর। দেবী নন্দিকেশ্বরীই এই সাঁইথিয়া শহর এবং সংলগ্ন এলাকার আরাধ্যা দেবী। দেবী এখানে নন্দিনী হিসেবে পূজিত হন। দেবীর ভৈরব নন্দিকেশ্বর। প্রায় প্রতিদিনই দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা দেবী নন্দিকেশ্বরী দর্শনে আসেন। নন্দিকেশ্বরীতলায় দেবী নন্দিনী ছাড়াও নানা দেবদেবীর মন্দির রয়েছে।
মহাসরস্বতী, মহালক্ষ্মী, বিষ্ণুলক্ষ্মী, জলারামবাবার মন্দির, হনুমান মন্দির, জগন্নাথদেবের মন্দির, কালীয়দমন মন্দির ঐ একই প্রাঙ্গনে নির্মিত হয়েছে। সারা বছরই দেবীর দর্শনাকাঙ্ক্ষায় নন্দিকেশ্বরী মন্দিরে ভক্তদের আগমন ঘটে। নববর্ষ, বিজয়া দশমী, বিভিন্ন ব্রত পার্বণে এখানে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। আজ ও সাঁইথিয়া শহরের ব্যবসায়ীরা দেবী নন্দিকেশ্বরীর পুজো দিয়ে তাদের নববর্ষ শুরু করেন।
এবার যাব বীরভূমের অন্যতম শহর লাভপুরে। লাভপুর বিখ্যাত আরেক স্বনামধন্য বাঙালির জন্যও। তিনি প্রথম জ্ঞানপীঠ জয়ী বাঙালি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম এবং বাসস্থান এই লাভপুরেই।
এই লাভপুরেই আছেন দেবী ফুল্লরা। এই দেবী পীঠ একটি সতীপীঠ। দেবী ফুল্লরাকে নিয়ে কত কিংবদন্তী প্রচলিত। পীঠনির্য়তন্ত্র অনুযায়ী এখানে পড়েছিল দেবী সতীর ওষ্ঠ - দেবীর অপর নাম অট্টহাস।
ফুল্লরা মন্দিরের আদি ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবের। ইতিহাস থেকে জানা যায় পাল রাজবংশের বংশোদ্ভূত নয়পাল বা তাঁর পুত্র তৃতীয় বিগ্রহ পাল (আনুমানিক ১০২৭-৭০ খ্রিস্টাব্দ) এই অট্টহাস মন্দির নির্মাণ করেন। এর চূড়ায় থাকা ছিল এক স্বর্ণ কলস। সেই সোনার কলসটির আলোকদ্যুতিতে মনে হত যেন আকাশে আরেকটি সূর্য উঠেছে।
এর পরে দিনমণি মিশ্র বাহাদুরের আমলে এই মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে কৃষ্ণানন্দ গিরি একটি ছোট্ট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সে মন্দিরটিও কালের প্রভাবে ভেঙেচুরে যাওয়ায় গ্ৰামের জমিদার যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৫ সালে তৈরি করেন সর্বশেষ নতুন মন্দিরটি। এই মন্দিরের পাশে একটি বিরাট পুকুর আছে। কিংবদন্তি অনুসারে, শ্রীরামচন্দ্র যখন দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন তখন হনুমান এই পুকুর থেকেই ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন।
কথিত, বুদ্ধগয়ার শ্রীমৎশঙ্করাচার্য মঠের সন্ন্যাসী কৃষ্ণানন্দ গিরি স্বপ্নে দেবীর আদেশ পেয়ে সাক্ষাৎ মাতৃদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় কাশীধাম থেকে মাঘীপূর্ণিমা তিথিতে লাভপুরে এসে পৌঁছেছিলেন। লাভপুর তখন গভীর জঙ্গল পরিবৃত এক গ্ৰাম মাত্র। সেই জঙ্গলে তিনি কচ্ছপের পিঠের আকৃতির একটি শিলাময় মাতৃমূর্তি নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন। এই মাতৃমূর্তিকেই দেবী রূপে পূজা করা হয়। প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে মায়ের বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। মাঘী পূর্ণিমার দিন শুরু হয় ফুল্লরা মহামেলা। এখানে দেবীর ভৈরব বিশ্বেশ মহাদেব।
এই দুই দেবী পীঠের মাহাত্ম্য বর্তমানে জেলা বা রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাণের টানে ভক্তদের আসা-যাওয়া চলে সারাবছর। ধর্মপ্রাণ মানুষের বা সাধারণ পর্যটকদের কাছে এই অতি পুণ্য স্থানগুলিতে রেলপথে অথবা বাসে যাতায়াতের এবং থাকারও সুব্যবস্থা রয়েছে।
আজ এই পর্যন্তই থাক। পরের পর্বে বীরভূম শেষ হবে। তারপর আবার নতুন জেলা নতুন কথা...
সবাই ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন।