বীরভূম জেলায় এবার আমার পাঠক বন্ধুদের নিয়ে একটু বেড়াতে যাব এখানকার শক্তিপীঠগুলোতে। বীরভূম জেলার মাটি বড় পুণ্য ভূমি। এই জেলাতে যেমন বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতন রয়েছে তেমনই বামাক্ষ্যাপার মত শ্রেষ্ঠ সাধকও এই জেলারই তারাপীঠে তাঁর তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এই জেলায় আছে চার চারটি (মতান্তরে পাঁচটি) সতীপীঠ যা পশ্চিমবঙ্গ কেন ভারতের অন্য কোন রাজ্যে অথবা জেলাতেও নেই। পুরাণ মতেও বীরভূম তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের পীঠভূমি। বেশ কয়েকটি সতীপীঠ ধারণ করে রাখা বীরভূমে শক্তির আরাধনা হয় সারা জেলাতেই। সেদিক দিয়েও বীরভূম অনন্য।
এবার আসি শক্তিপীঠ বা সতীপীঠগুলির ইতিহাসে। প্রথমেই সতীপীঠ কী অথবা কেন তৈরি হয়েছিল সে নিয়ে ছোট্ট একটা আলোচনা করে নিই। রাজা দক্ষের কন্যা দেবী সতী তাঁর পিতার অমতে মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন দক্ষ রাজা। সেখানে দক্ষ মহাদেবের নিন্দে করতে থাকলে পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞের আগুনে আত্মঘাতী হন সতী।
ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন মহাদেব। সতীর দেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন তিনি। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার হওয়ার উপক্রম হয়। ভগবান বিষ্ণু এই প্রলয় থামাতে তাঁর অস্ত্র সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে দেন। সুদর্শন চক্রের আঘাতে দেবীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে। এই জায়গাগুলিকে সতীপীঠ বলা হয়। এই একান্ন পীঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পবিত্র স্থান। ভারতবর্ষ ছাড়াও বাংলাদেশ,পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় এই ৫১টি পীঠের কয়েকটি অবস্থিত। এই পীঠ বা পবিত্র তীর্থস্থানগুলির মধ্যে বীরভূমের চারটি প্রধান সতীপীঠ হল দেবী নলাটেশ্বরী (নলহাটি), দেবী নন্দিকেশ্বরী (সাঁইথিয়া), দেবী ফুল্লরাতলা (লাভপুর) ও দেবী কালী কঙ্কালীতলা (বোলপুর)। এছাড়াও রয়েছে বক্রেশ্বর যা নিয়ে আগেই লিখেছি।
১) দেবী নলাটেশ্বরী
বীরভূমের নলহাটি স্টেশনের কাছাকাছি এই স্থানে দেবী সতীর নলা বা কন্ঠনালী পড়েছিল। সেই থেকে এই পীঠের নাম নলাটেশ্বরী। এই সতীপীঠের নামানুসারেই জায়গাটির নাম দেওয়া হয়েছিল নলহাটি। বীরভূম জেলার ব্রাহ্মণী নদীর তীরে দেবী নলাটেশ্বরীর মন্দির। দেবী এখানে মা কালিকা রূপে পূজিতা হন। দেবী মায়ের ভৈরব যোগেশ। এই পীঠস্থানে মা আমিষাশী। বছরের ৩৬৫ দিনেই এখানে দেবীমাকে অন্ন ভোগ দেওয়া হয়।
২)কঙ্কালীতলা পীঠ
পুরাণে কথিত ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম কঙ্কালীতলা মন্দির বীরভূমের বোলপুর স্টেশন থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, দক্ষযজ্ঞের পর দেবী দেহের কঙ্কাল এখানে পড়েছিল। তাই এই জায়গার নাম কঙ্কালীতলা। এখানে দেবী দেবগর্ভা নামে পূজিতা হন। এই পীঠে দেবীর কোন বিগ্ৰহ নেই। দেবীর ভৈরবের নাম রুরু। প্রতি দীপান্বিতা কালী পুজোর অমাবস্যার রাতে এই মন্দিরে রীতি মেনে শান্তি যজ্ঞ হয়ে থাকে। কঙ্কালীতলায় দেবীর মন্দিরের পাশে একটি কুণ্ড আছে। সেই কুণ্ডে কিছু পাথর আছে। মন্দিরের পুরোহিতদের মতে এগুলো দেবীর দেহাংশ। ২০ বছর পরপর এই পাথরগুলো তোলা হয়। পূজা শেষ হলে সেগুলি আবার কুণ্ডে রেখে দেওয়া হয়।
কঙ্কালীতলার এই কুণ্ড নিয়ে বহু কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।
এই কুণ্ড হল কঙ্কালীতলা মন্দিরের পাশেই থাকা পাড় বাঁধানো একটি ছোট পুকুর, এর সিঁড়ি জলের মধ্যে নেমে গেছে। এটাই নাকি আসল সতীকুণ্ড যার মধ্যে সতীর কঙ্কাল পড়েছিল। প্রচলিত মতে, বিষ্ণুর সুদর্শনচক্রের আঘাতে সতীর অস্থি এখানে এত জোরে পতিত হয়েছিল যে তার আঘাতে এই কুণ্ডর সৃষ্টি হয়েছিল। এই কুণ্ড অতি পবিত্র বলে মানুষের বিশ্বাস।
প্রচলিত রয়েছে যে তিনটি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে এই কুণ্ডের যোগ রয়েছে কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাটের সঙ্গে। তার মধ্যে একটি দিয়ে সারাবছর ওই কুণ্ডে জল আসে। আর সেই কারণেই কঙ্কালীতলার এই কুণ্ড কখনও শুকোয় না। তবে দেবীর ইচ্ছা অনুসারে প্রতি ১৯-২০ বছর পর পর নাকি একবার করে কুণ্ডটি শুকিয়ে যায়। আর ঠিক সেই সময় কোন না কোন কারণে মণিকর্ণিকা ঘাটও বন্ধ হয়ে যায়। আবার পুজো পাঠের পরে রাতারাতি জলে ভরে যায় কুণ্ড।
কঙ্কালীতলা মন্দিরের পাশের শ্মশান তন্ত্রসাধকদের সাধনার জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে প্রতি অমাবস্যায় দেবীর ছবি দিয়েই বেশ জাঁকজমক সহকারে পূজা করা হয়।
পাঠক বন্ধু, বাকি শক্তিপীঠগুলিতে আমরা পরের সপ্তাহে যাব কেমন? আপনারা সবাই সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন। আর মাস্ক পরুন, ঘরে থাকুন। ঘরে বসেই না হয় আমরা বেড়াতে যাই!...