আগের পর্ব গুলিতেই লিখেছিলাম বীরভূম নামটি বীর শব্দ থেকে এসেছে। মুণ্ডারি ভাষায় বীর শব্দের অর্থ জঙ্গল। তাই গোটা বীরভূম জেলাতেই যে প্রচুর গাছপালা থাকবে সে আর নতুন কী? কিন্তু এই পর্বে বীরভূম জেলার একমাত্র পাহাড় মামা ভাগ্নে পাহাড় সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানাই। বীরভূমের মাটি হলো রাঙামাটি অর্থাৎ এই জেলা লালমাটির জেলা।
কিন্তু বীরভূমের ভূমি মূলতঃ সমতলভূমি। কোথাও কোনো পাহাড় বা টিলা নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম এই "মামা ভাগ্নে" পাহাড়। বীরভূমের দুবরাজপুর শহর দিব্যি সমতল ভূমির উপর গড়া। তারই একপ্রান্তে মাথা উঁচু করে হঠাৎ যেন গজিয়ে উঠেছে ‘মামা ভাগ্নে পাহাড়’। ছোটো নাগপুর মালভূমির অন্তর্গত দুবরাজপুরের এই জায়গাটি বর্তমানে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে রীতিমত পরিচিতি লাভ করেছে।
এই বিক্ষিপ্ত টিলা ও ছড়িয়ে থাকা পাথরের টুকরো বহু কিংবদন্তীর জন্ম দিয়েছে। প্রচলিত আছে রাম যখন সীতাকে উদ্ধারের জন্য লঙ্কা যাত্রা করেন তখন হিমালয় থেকে সমুদ্রের উপর সেতু বন্ধের জন্য পাথর রথে করে আনা হচ্ছিল। সেসময় কিছু পাথর পড়ে গিয়ে মামা ভাগ্নে পাহাড়ের জন্ম হয়েছে।
আরো একটি কিংবদন্তী বলে মহাদেব একবার দেব বিশ্বকর্মাকে আদেশ দিয়েছিলেন যে একদিনের মধ্যে দ্বিতীয় কাশী তৈরি করে দিতে হবে। বিশ্বকর্মা মহেশ্বরের আদেশ পালন করার জন্য প্রচুর পাথর নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই পাথর থেকেই এখানে কিছু পাথর পড়ে গিয়ে এই পাহাড়ের সৃষ্টি।
এক বর্গকিমি জুড়ে বিভিন্ন মাপের বিভিন্ন আকৃতির গ্রানাইট পাথর নিঁখুত ভাবে সাজানো, একটার উপরে আর একটি বসে তৈরি হয়েছে এই পাহাড়। সবথেকে উঁচু দুটি পাথর একটা পনেরো ফুট উচ্চতার এবং আরেকটি বারো ফুট... দুটিতে যেন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরাই হল মামা এবং ভাগ্নে। পাহাড়ের গায়ে হালকা জঙ্গল।
সেই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের উপরে ওঠা বেশ রোমাঞ্চকর। পাহাড়ের উপরে ও নীচে রয়েছে দু’টি মন্দির। নীচে রয়েছে তিলেশ্বর মহাদেবের মন্দির। এই মন্দিরের মধ্যে থাকা শিবলিঙ্গের শিলাটি প্রতিদিন নাকি তিল তিল করে বেড়ে উঠছে। তাইই এমন নামকরণ। টিলার উপরে আছে একটি কালীমন্দির। এই দেবী মা শ্যামাঙ্গী নামে পরিচিত। পাহাড়ের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে যায়।
পাহাড় থেকে নেমে যাওয়া যায় নীল নির্জন জলাধারে। সারাদিন নৌকা ভাড়া নিয়ে সেই জলাধারে ভেসে থাকা যায়। বক্রেশ্বর নদীর উপরে বাঁধ দিয়ে নীল নির্জন জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। এই জলাধার থেকে বক্রেশ্বর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জলও সরবরাহ করা হয়। এই জলাশয়ের ধারে দু’দণ্ড বিশ্রামের জন্য বসলে চারপাশ থেকে কত জানা অজানা পাখির ডাক শুনে শরীর মন জুড়িয়ে যায়।
বীরভূমের দুবরাজপুরের এই মামা ভাগ্নে পাহাড়ে পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের এবং সন্দীপ রায়ের একাধিক সিনেমার শুটিং হয়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছবি হল "অভিযান"। যে রাজবাড়িটিতে "গুপি গাইন বাঘা বাইন" ছবির শুটিং হয়েছিল সেই রাজবাড়িটি আদতে এই দুবরাজপুরের কাছেই অবস্থিত হেতমপুর রাজবাড়ি।
পরের পর্বে আলোচনা করবো বীরভূমের শক্তিপীঠগুলি নিয়ে। পাঠক বন্ধুরা, সবাই সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন আর মাস্ক পরে ছাড়া কখনো বেরোবেন না কেমন? সামনের সপ্তাহে আবার নতুন পর্ব নিয়ে আসছি...