জেলার নাম বীরভূম - পর্ব ৯

আজ দু'মাস ধরে আমরা বীরভূমে। আমরা মানে আমি এবং আমার পাঠক বন্ধুরা হয়তো সশরীরে সবাই বীরভূমে নেই কিন্তু মনে মনে কবি জয়দেব, চণ্ডীদাস, বামাক্ষ‌্যাপা, অমর্ত্য সেন এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলি ধন্য এই জেলাতেই গত দু মাস ধরে ঘোরাঘুরি করে ফিরছি। আজ শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য- সংস্কৃতির পীঠস্থান একই সঙ্গে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থান এই জেলায় হয়তোবা শেষ দিন আমাদের মানস ভ্রমণের।

নানুর....এই নামটা শুনলেই কার নাম মনে পড়ে বলুন তো? ঠিক... বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। ("বড়ু" শব্দটি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ বলে মনে করেন গবেষকরা)। তাঁর জন্মস্থান হলো বীরভূমের নানুর। তিনি ছিলেন চতুর্দশ শতকের মানে চৈতন্য মহাপ্রভুরও আগের সময়ের এক বিখ্যাত কবি। চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা হিসেবে তাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে।

BirbhumPartIX1

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। চৈতন্যদেবের জন্মের আগে থেকেই চণ্ডীদাসের বহু গীতিপদ বা গীতিকবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরত। চৈতন্যদেব নিজে তার রচনা পাঠ করে তার আস্বাদ গ্রহণ করতেন। বহু গবেষকদের মতে, তিনিই মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন" রচনা করেছেন। প্রচলিত জনশ্রুতি, রজকিনী রামী তার সাধনসঙ্গিনী ছিলেন। তবে চণ্ডীদাস এর সত্যতা নিজেই স্বীকার করে গিয়েছেন তাঁর পদে..
"শুন রজকিনী রামী ও দুটি চরণ তলে শীতল জানিয়া শরন লইনু আমি"

সহজিয়া গুরুবাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি লিখে গিয়েছেন সেই অমর বাক্য....

"শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।"

চণ্ডীদাসের আরাধ্যা দেবী বাসুলির মন্দির এই নানুরেই রয়েছে এখনো।

BirbhumPartIX2

এবার কেঁদুলিতে যাওয়া যাক। গীতগোবিন্দ কাব্যগ্ৰন্থের রচনাকার কবি জয়দেব জন্ম গ্ৰহণ করেছিলেন বীরভূমে অজয় নদের তীরে কেঁদুলিতে। জয়দেব রাজা লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ছিলেন বলে ইতিহাসবিদদের মত। প্রত্যেক বছর মকর সংক্রান্তির দিন কেঁদুলিতে বিরাট জয়দেব মেলা বসে যেখানে সারা বীরভূম থেকে তো বটেই-- দেশ বিদেশ থেকেও বাউল ফকিররা আসেন। বর্ধমানের মহারাণী ব্রজকিশোরীদেবী ১৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রামে জয়দেবের জন্মভিটেয় রাধাবিনোদ মন্দির স্থাপন করেন। এইখানে জয়দেব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাধামাধবের মূর্তির পুজো করা হয়ে থাকে এবং যে আসনে বসে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেই আসনটি সংরক্ষণ করা হয়।

রামপুরহাটের কাছে আকালীপুরের গুহ্যকালী দেবীর থান ও পর্যটকদের কাছে একটি বিশেষ দর্শনীয় স্থান। এই দেবী সাপের ওপর অধিষ্ঠিত। তাঁর সব গয়না... হাতের, কোমরের এমনকী মাথার মুকুটও সাপ দিয়ে তৈরি। আট কোনা মন্দিরে কষ্টি পাথরের মূর্তিটি বেশ বড়সড় । জনশ্রুতি মূর্তিটি মগধের রাজা জরাসন্ধের দ্বারা নির্মিত।

BirbhumPartIX3

পরে বিভিন্ন রাজার হাতে পূজিত হওয়ার পর কাশীরাজ চৈত সিংহের রাজ্যের এক কৃষক তার জমিতে মূর্তিটি খুঁজে পান। খবর পেয়ে মহারাজ চৈত সিংহ মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। মূর্তিটি কাশীরাজ নিজের বাড়িতে রেখেই পূজা অর্চনা করতেন। কিন্তু সেইসময় ছিল ইংরেজ রাজত্ব। চৈত্য সিংহের অনেক টাকা খাজনা বাকি পড়ে যাওয়ায় গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ওই কুলদেবীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

হেস্টিংস এর ইচ্ছে ছিল দেবীমূর্তিটি তিনি রাজার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে লণ্ডনের মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেবেন। তার মতলব বুঝতে পেরে দেবীকে বাঁচাতে মহারাজ চৈত্য সিংহ গঙ্গার জলে ডুবিয়ে রেখেছিলেন মূর্তিটি। ভদ্রপুরের মহারাজা নন্দকুমার সেকথা জানতে পেরে দেবীকে উদ্ধার করে, নৌকাতে করে ব্রাহ্মণী নদী দিয়ে ভদ্রপুরে নিয়ে এসেছিলেন। নন্দকুমার নিজে ছিলেন পরম শাক্ত ও দেবী মহাকালীর ভক্ত।

১৭৭৫ সালের শুরুর দিকে তিনি বীরভূমের আকালীপুর গ্রামে দেবী গুহ্যকালীর মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু ওই বছর জুন মাসে তিনি ইংরেজের হাতে বন্দী হন এবং মন্দির নির্মাণে ছেদ পড়ে। ইংরেজরা অন্যায়ভাবে বিচারের নামে এক প্রহসন করে এবং তাঁর ফাঁসীর আদেশ দেয়। ফাঁসির আগে তিনি তাঁর পুত্র গুরুদাসকে তান্ত্রিক মতে দেবী গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে যান। গুরুদাস বাবার আদেশ পালন করেন এবং ওই বছর ১৫ জুলাই মন্দিরের দরজা সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল।

BirbhumPartIX4

দেবী গুহ্যকালীর ধ্যানমন্ত্রে তার যে মূর্তিটি বর্ণিত হয়েছে তা এমন-- গুহ্যকালীর গায়ের রং গাঢ় মেঘের মতো, তিনি লোলজিহ্বা ও তাঁর দুই হাত, গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা, কাঁধে নাগযজ্ঞোপবীত অর্থাৎ সাপের তৈরি পৈতে, মাথায় জটা ও অর্ধচন্দ্র, কানে শবদেহরূপী অলংকার; হাসিমুখ, চতুর্দিকে সাপের ফণা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা, বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ, বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা। অর্থাৎ তাঁর সর্ব অঙ্গে সাপ। তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফল প্রদানকারিণী। ভদ্রপুরের রাজা তাঁকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে তাঁর এক নাম ভদ্রকালী।

দেবীর মন্দিরের দক্ষিণ দিকে "পঞ্চমুণ্ডী" নামে পরিচিত একটি সিদ্ধাসন রয়েছে। আকালীপুরের দেবী গুহ্যকালী স্থানীয় মানুষের তথা ভক্তদের কাছে অতি "জাগ্রত" দেবী। দূর-দূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা এই মন্দিরে মায়ের দর্শনে আসেন এবং দেবীর কাছে "মানসিক" করে পুজো দেন, মনোস্কামনা পূর্ণ হলেও পুজো দিয়ে যান।

নাহ্, আরেক সপ্তাহও আমাদের বীরভূমে থাকতেই হচ্ছে। এই পর্ব এখানে শেষ করি? পাঠক বন্ধুরা, আমার সঙ্গে জেলায় জেলায় ঘুরতে ভালো লাগছে তো? সবাই ভালো থাকুন কিন্তু।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...