ভৌগলিক বিচারে বীরভূম জেলা ছোটনাগপুর মালভূমির উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত। লাল মাটির এই জেলায় আবহাওয়া সাধারণত চরমভাবাপন্ন। অর্থাৎ গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম পড়ে। কখনও কখনও এই জেলার তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। শীতকালে আবার পারদ ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও নিচে নেমে যায় কোন কোন দিন।
বীরভূম জেলার দর্শনীয় স্থানের কোনো অভাব নেই। বেড়ানোর জন্য এই জেলা একেবারে আদর্শ। বেড়াতে গিয়ে আমরা কী কী দেখব, কোন কোন নদী দেখে, তাতে পা ভিজিয়ে মুগ্ধ হব, পাহাড় বা জঙ্গলে বেড়িয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠব, কোন কোন মন্দিরে গেলে ভক্তিতে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাবে সেই বর্ণনা আগের বীরভূম পর্বেই লেখা শুরু করেছিলাম। এবারের পর্ব শুরু করব শান্তিনিকেতন নিয়ে।
শান্তিনিকেতন। বিশ্বকবির বিশ্বভারতী আর শান্তিনিকেতন এখন একটা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সারা পৃথিবীর অতি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তার উদ্দেশ্যে বীরভূমের বোলপুর শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকে কুড়ি বিঘা জমি কিনে সেখানে শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়। ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
এরপর ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর, (১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ) রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সংস্কৃতির যথার্থ একটি কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। তাঁর ঐকান্তিক বাসনা ছিল বিশ্বের সংস্কৃতিসমূহের সমন্বয় ও সহযোগিতায় এক আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যেখানে ছাত্রদল প্রাণের আনন্দে পড়াশুনা করবে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রথমে ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এবং পরবর্তীকালে বিশ্বের সব দেশের সংস্কৃতিতে সৃজনশীল হয়ে বিশ্বজনীন সংস্কৃতির লালন করবে। তাঁর এই বাসনাই বিশ্বভারতীর জন্ম দিয়েছিল।
তিনি লিখেছিলেন “সেবা করতে ও পেতে, দিতে এবং নিতে, বিশ্বের সঙ্গে আমাদের অবশ্যই একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডার থেকে ভারত বিচ্ছিন্ন, শিক্ষার নামে সে যা পায় তা সামান্য। বিশ্বের তুলনায় ভারতের শিক্ষা প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ের। আমরা এখন এই আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবমাননা থেকে মুক্তি চাই।”
কবিগুরু আরও লিখেছিলেন... “এই প্রসারিত ও পরস্পর গ্রথিত পথে আমাদের নিজেদেরকে উপলব্ধি করতে হবে, নচেৎ আমরা যে শিক্ষা লাভ করব তা হবে ভিক্ষুকের মতো। ভিক্ষা করে কোন জাতি ধনী হতে পারে না।”
গবেষণা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানের মধ্য দিয়েই শান্তিনিকেতনের কার্যপদ্ধতি গড়ে উঠেছিল। নতুন শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় মানসকে হীনম্মন্যতা থেকে মুক্ত করাও ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা। তিনি ভেবেছিলেন যে, এটি যদি সম্ভব হয় তাহলে সেই শিক্ষা জীবিকার প্রয়োজনের বাইরেও জীবনের মূল উদ্দেশ্য প্রকাশ করবে। শিক্ষার শুরু থেকেই শিশুরা সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের অর্থ উপলব্ধি করুক রবীন্দ্রনাথ এটাই চেয়েছিলেন।
"যত্র বিশ্বম্ ভবেত্যকনীড়ম”... (যেখানে বিশ্ব একটি নীড়ে পরিণত হবে) কে বিশ্বভারতীর মূলমন্ত্র রূপে গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু তাঁর সাধের এই শিক্ষালয়ের আচার্য ছিলেন। তাঁর তিরোধানের পর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সরোজিনী নাইডু হয়েছিলেন বিশ্বভারতীর আচার্য।
সামনেই তো তাঁর জন্মদিন আসছে। তাই হয়ত আজ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে একটু বড় আলোচনা করে ফেললাম। আজ এটুকু থাক? পরের পর্বে বীরভূমের সংস্কৃতি ও ভ্রমণ নিয়ে আরও অনেক কথা আলোচনা করব কেমন?