জেলার নাম বীরভূম - পর্ব ৩

আমাদের বাংলার প্রতিটা জেলাই নিজের নিজের বিশিষ্টতায়, স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। সে উত্তর বঙ্গের দার্জিলিং বা আলিপুরদুয়ার হোক অথবা দক্ষিণ বঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বা কলকাতা। প্রাকৃতিক সম্পদ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মানব সম্পদ-- যাকে আমরা হিউম্যান রিসোর্স বলে থাকি.... প্রত্যেকটাতেই সমৃদ্ধ আমার বঙ্গের প্রতিটি জেলা।

আর এখন যে জেলায় আমরা রয়েছি তার তো সমৃদ্ধি অশেষ। স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখেছেন এই রাঙামাটির জেলাকে নিয়ে। এই জেলার নদীর নামগুলোও কি সুন্দর! অজয়, কুনুর, ময়ূরাক্ষী, কোপাই, বক্রেশ্বর, ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, হিংলো, চপলা, বাঁশলৈ, পাগলা নদী....নদীর নাম পাগলা! কেমন চমৎকার নাম! আর কোপাই নদী! এই নদীর অববাহিকায় মাটির রং লাল। এই মাটিতে ভূমিক্ষয়ের ফলে যে ছোট ছোট খাত সৃষ্টি হয় আর সেই খাত "খোয়াই" নামে পরিচিত।

BirbhumPartIII1

এই কোপাই নিয়ে বিশ্বকবির সেই বিখ্যাত কবিতা..."আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে"...। অজয়, কুনুর, কোপাই নদী উপত্যকায় খ্রিস্টপূর্ব বারোশো অব্দের মাইক্রোলিথ স্ফটিক পাথর ও প্রস্তরীভূত কাঠ বা ফসিল পাওয়া গিয়েছে।

জ্ঞানপীঠ জয়ী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশিরভাগ গল্প বা উপন্যাস বীরভূম জেলাকে কেন্দ্র করেই লেখা। তাই বীরভূম জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গর্ব করার মতই।

এবার আসি বীরভূমের বিখ্যাত কিছু স্থানের বর্ণনায়। বীরভূমের সদর শহর শিউড়ি। এখানে একটা ছোট তথ্য জানান যাক। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি (একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতি) শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এই বীরভূম জেলারই ভূমিপুত্র ছিলেন। তাঁর পৈত্রিক ভিটে ছিল বীরভূমের কীর্ণাহারে। এটাও আমাদের অহঙ্কারী হওয়ার সুযোগ করে দেয় না কি?

BirbhumPartIII2

এরপর আসি বক্রেশ্বরে। বক্রেশ্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়ি সদর মহকুমার দুবরাজপুরে অবস্থিত। বক্রেশ্বর গরম জলের ঝর্ণা অর্থাৎ উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য বিখ্যাত। বক্রেশ্বর নামটি এসেছে স্থানীয় বক্রেশ্বর শিবের নাম অনুসারে। এখানে দশটি প্রাকৃতিক গরম জলের ধারা রয়েছে।

তাদের নাম হলো (১) পাপহরা গঙ্গা (২) বৈতরণী গঙ্গা (৩) খার কুণ্ড (৪) ভৈরব কুণ্ড (৫) অগ্নি কুণ্ড (৬) দুধ কুণ্ড (৭) সূর্য কুণ্ড (৮) শ্বেত গঙ্গা (৯) ব্রহ্ম কুণ্ড (১০) অমৃত কুণ্ড। এদের মধ্যে অগ্নি কুণ্ডের জলের তাপমাত্রা ৮০ ডিগ্ৰী সেলসিয়াস। এই উষ্ণ প্রস্রবনের জলে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ মিশে আছে। তাই বহু মানুষ বিশ্বাস করেন যে এই প্রাকৃতিক উষ্ণ জলের প্রস্রবনে স্নান করলে বহু রোগের উপশম হয়।

পশ্চিমবঙ্গের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির অন্যতম বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রও এখানেই গড়ে উঠেছে। এই বক্রেশ্বর শিবের মন্দির, উষ্ণ জলের ঝর্ণা বা কুণ্ড এবং একাধিক মন্দির নিয়ে বক্রেশ্বর একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

BirbhumPartIII3

ম্যাসেঞ্জোর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রও এই জেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ময়ূরাক্ষী নদীর উপর বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে যদিও এই ড্যাম্পটি বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমান্তে তৈরি করা হয়েছিল।

রাঙা মাটির দেশ বীরভূম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের ডালা সাজিয়ে যেন দু'হাত বাড়িয়ে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষকে ডাকতে থাকে। এই জেলার বোলপুরে শান্তিনিকেতনের কাছেই গড়ে তোলা হয়েছে সবুজে ঘেরা জঙ্গল বল্লভপুর অভয়ারণ্য যেখানে বণ্যপ্রাণী... বিশেষতঃ চিতল হরিণ সংরক্ষণ করা হয়।

টিকিট কেটে এই জঙ্গলে ঢুকে বণ্যপ্রাণীদের বিশেষতঃ চিতল হরিণদের অবাধ বিচরণ দেখার মজাই আলাদা। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ হরিণ সংরক্ষণ কেন্দ্রটি ১৯৭৭ সালে দামোদর এবং অজয় নদের মধ্যবর্তী স্থলভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছিল। ২০০ হেক্টর জমির ওপর গড়ে ওঠা এই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটিতে প্রচুর চিতল হরিণ ছাড়াও কালো হাঁস সহ শীতকালে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে।

BirbhumPartIII4

এবার যাব আমরা এমন একটা জায়গায় যেই স্থান সমস্ত বাঙালির কাছে পুণ্যভূমি। লালমাটি, মেঠো পথ, কোপাই-খোয়াই, আদিবাসী,সাঁওতাল, বিশ্বভারতী, সোনাঝুড়ি কিংবা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বেঁচে থাকা সেই ঠিকানার নাম শান্তিনিকেতন। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়
"শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী
প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি।" ..

আমার পাঠক বন্ধুরা, শান্তিনিকেতন নিয়ে এবং বীরভূমের অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান নিয়ে, সেখানকার বিখ্যাত কুটির শিল্প নিয়ে, বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে লিখব পরের পর্বে। আজকের মত বিদায় নিলাম। সবাই সাবধানে থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। মাস্ক অবশ্যই পরবেন। কত জায়গায় এখনো বেড়াতে যাওয়া বাকি রয়েছে বলুন তো!..

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...