বীরভূম জেলার ইতিহাস বেশ পুরনো। বীরভূম একসময় মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৮৭ সালে বীরভূমকে প্রথম প্রশাসনিক জেলার স্বীকৃতি দেয়। তখন কিন্তু বীরভূম জেলা বেশ বড়সড় একটা জেলা ছিল। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর ও সাঁওতাল পরগণা তখন বীরভূম জেলারই অন্তর্গত ছিল। কিন্তু বীরভূম তো চিরদিন বীর যোদ্ধাদের দেশ।
ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরুও হয়েছিল বীরভূমে। তাই সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করার জন্য আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে ইংরেজরা বীরভূম থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছিল। একই সঙ্গে বীরভূম থেকে বিষ্ণুপুরকেও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর আগের পর্বেই লিখেছিলাম যে সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই বীর সৈনিক সিধু ও কানহো ছিলেন এই জেলারই সন্তান। তারপরই বীরভূম জেলা আজকের এই রূপ নিয়েছিল।
ইতিহাস বলে এই অঞ্চলে একসময় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বেশ ভালো প্রভাব ছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাব কমে যাওয়ার পর রাঢ় বীরভূম মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর বাংলার এই অঞ্চল শাসন করেন গুপ্তরাজারা, সম্রাট শশাঙ্ক, সম্রাট হর্ষবর্ধন, পাল রাজারা, তারপর সেন রাজাদের শাসনাধীন ছিল বীরভূম।
কথিত আছে যে খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সুবর্ণগ্রাম এবং লক্ষণাবতীর শাসকেরা পরস্পর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এইরকম অস্থির একটা সময়ে বীর নামের এক যোদ্ধা বীরভূমের তৎকালীন রাজধানী লক্ষুরে নিজের প্রাধান্য বিস্তার করে রাজা হয়ে বসেন। বীরভূম সহ রাঢ় অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশে এরপর মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু তারই মধ্যে রাজত্ব ধরে রেখেছিলেন বীর রাজবংশের সদস্যরাও সম্ভবত এই পরাক্রমশালী বীর রাজার নামেই এই জেলার নাম হয়েছিল। অনুমান করা হয় বীরভূম জেলার সদর শহর শিউড়ির নাম ও এসেছে "শৌর্য" থেকে।
অন্য একটি প্রচলিত কাহিনী এরকম - বিষ্ণুপুরের রাজা একদিন শিকার করতে বেরিয়ে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁর একটি পোষা বাজপাখি ছিল। বাজপাখিটি একটা বক'কে তাড়া করতে গেলে সেই বকটিই ভয় না পেয়ে বাজটির দিকে তেড়ে আসে। উল্টে বাজপাখিটিই ভীত হয়ে পালিয়ে ফিরে আসে রাজার কাছে। তখন বিষ্ণুপুররাজ ভাবলেন যে যেখানকার একটা সামান্য বক পাখিই এত নির্ভীক, সেখানকার মানুষরা না জানি কত বীর। তখন তিনিই এই অঞ্চলের নাম দিলেন বীরভূমি যা পরবর্তী সময়ে লোকমুখে হয়ে যায় বীরভূম।
পুরাণ ও বিভিন্ন কিংবদন্তী অনুযায়ী, বীরভূম হল তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের পীঠস্থান। বেশ কয়েকটি সতীপীঠ বুকে ধরে আছে রাঙামাটির জেলা বীরভূম। শক্তিদেবীর আরাধনা হয় এই জেলার বেশ কয়েকটি শহরে বা গ্ৰামে। কবি জয়দেব, বৈষ্ণবপদাবলীর রচয়িতা চণ্ডীদাস, সাধক বামদেব, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ অমর্ত্য সেন, সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলি ধন্য বীরভূমের সংস্কৃতির ঐতিহ্য আমাদের গর্ব।
লালমাটির বীরভূমে দেখার জায়গাও কম নয় পরবর্তী পর্বে পাঠকদের নিয়ে যাব বীরভূমের কত সুন্দর সুন্দর জায়গায়। একটু অপেক্ষা করুন....