মহাকাশে আলোর দেখা

"আকাশভরা, সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান"।।

কবির ভাষাতেই আকাশভরা সূর্য-তারার অপার বিস্ময় ধরা পড়েছে। কাজেই আমাদের সকলের মধ্যেই কম-বেশি বিস্ময়তা কাজ করে আকাশের অবাক করা সৌন্দর্য নিয়ে। প্রাচীনকাল থেকেই তারাভরা আকাশ আমাদের কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে ছোট ছোট তারা আমাদের যেন সঙ্গী হয়। আবার ওই নক্ষত্রখচিত আকাশ আমাদের মনে অনেক প্রশ্নেরও উদ্রেক করে। সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে আমরা বুঝতে পেরেছি, একটি তারা বলতে কী বোঝায়।

    ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কিছু বিজ্ঞানী কল্পনা করলেন এমন এক বৃহৎ ভরের তারা, যা তার চারপাশ থেকে সমস্ত বস্তুকে টেনে নেয়। শুধু তাই নয়, প্রচন্ড ভরের ফলে ওই তারাটির মধ্যে সক্রিয় স্বঅভিকর্ষজ বলের ফলে তারাটি ক্রমাগত সংকুচিত হতে হতে ছোট হতে থাকে। এই ধারণাটিকেই একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব। যে কোনও ভারী বস্তু স্থান এবং কালকে বক্র করে তুলতে পারে। এই বক্রতা আলোকে সরলরেখায় ভ্রমণের থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে পারে। আবার অভিকর্ষজ সংকোচনী বক্রতাকে এতটাই বাড়িয়ে দিতে পারে, যার ফলে সৃষ্টি হতে পারে একটি বিন্দুসম কালের অসীম শূন্যতা। এর ফলে আলোর কণিকাও নির্গত হতে পারেনা। তারাটিকে শুধু অনুভব করা যায় তার তীব্র অভিকর্ষজ আকর্ষণের দ্বারা। এটাই ছিল কৃষ্ণ গহ্বর তত্ত্ব।

  একটি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃষ্ণগহ্বর অঞ্চল থেকে বিকিরণ নির্গত হতে পারে। এই বিকিরণকেই বলা হয় 'হকিং রেডিয়েশন' যেন কৃষ্ণগহ্বরটির বাষ্পীকরণ হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর, বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এলেন, যদি মহাশূন্যের নিঃসীম অন্ধকারে দূরবীন দিয়ে লক্ষ্য করা যায় একটি উজ্জ্বল চাকতির মত অঞ্চল, যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি অদৃশ্য অন্ধকারময় জগৎ, তাহলেই প্রমাণ হবে কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি।

   জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে মহাকাশে লক্ষ্য করলেন আর এক ধরণের অদ্ভুত বস্তুকে। আবিষ্কৃত হল অতি উজ্জ্বল এক প্রকারের মহাজাগতিক বস্তু। রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে এদের উপস্থিতি জানা গেল। এদের নাম দেওয়া হল কোয়াজার। এদের ভর, তারাদের থেকে কয়েক লক্ষ কোটি গুণ। আমাদের গ্যালাক্সী আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে যখন দেখা গেল বেশ কিছু তারা অত্যন্ত তীব্র গতিতে একটি অদৃশ্য বস্তুকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে, সেই অঞ্চল থেকে ছিটকে উঠছে প্রভূত পরিমাণে উত্তপ্ত গ্যাস, তখন বোঝা গেল, আমাদের গ্যালাক্সীর কেন্দ্রেও লুকিয়ে রয়েছে একটি বৃহৎ ভরের কৃষ্ণ গহ্বর। তার পাশাপাশিই রয়েছে একটি ঘুমন্ত বা আপেক্ষিকভাবে নিষ্প্রভ কৃষ্ণগহ্বর। আবিষ্কৃত হল সূর্যের থেকে প্রায় চল্লিশ গুণ ভারী একটি কৃষ্ণগহ্বর। তাঁরা এর নাম দিলেন ‘Sagitarious A’ পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান একটি অতি শক্তিশালী একটিভ গ্যালাকটিক নিউক্লিয়ার হল মেসিয়ের 87’ একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানীরা সৃষ্টি করে চললেন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সমস্ত দূরবীন, তড়িৎ চুম্বকীয় সকল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। সমস্যা হল, সৌরজগৎ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ‘M 87’ গ্যালাক্সীর কেন্দ্রীয় অঞ্চল, পৃথিবীর নিরিখে এতই ক্ষুদ্র, যে কোন একটি দূরবীন দিয়ে তাকে দেখা যায় না। বিজ্ঞানের অগ্রগতির স্বার্থে রূপ নিল একটি অভূতপূর্ব আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আটটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও দূরবীনের সংকেতকে সফটওয়ারের মাধ্যমে যোগ করে আপাতভাবে সৃষ্ট হল পৃথিবীর আয়তনের সমান একটি দূরবীন। গত দশ বছর ধরে পৃথিবীর প্রায় দুশো বিজ্ঞানী এই দূরবিণগুলোর মাধ্যমে নিরন্তর দেখে চলেছিলেন M 87 এবং আমাদের আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সীর কেন্দ্রে লুকিয়ে থাকা কৃষ্ণগহ্বর দুটিকে। নিরন্তর এই পর্যবেক্ষণের ফল তাঁরা প্রকাশ করেছেন গত ১০ এপ্রিল।

    M 87 থেকে সংগৃহিত সংকেতগুলিকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যোগ করে বিজ্ঞানীরা সৃষ্টি করেছেন কৃষ্ণগহ্বরের একটি বাস্তবরূপী চিত্র। ছবিটি প্রকাশ হওয়ার পরে সারা পৃথিবীর মানুষ দেখেছেন একটি অস্পষ্ট আলোর চাকতির ছবি। অন্ধকারের বুকে একটি উজ্জ্বল বৃত্ত। যার নিচের ভাগটা অপেক্ষাকৃত বেশি উজ্জ্বল। এটি হল কৃষ্ণগহ্বরের ইভেন্ট হরাইজনের বহির্দৃশ্য। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী একটি অতি ঘন বৃহৎ ভরের বস্তু স্থান-কালকে এতটাই বক্র করে দিতে পারে যে আলোকরশ্মি বক্রপথে একটি সাধারণ বস্তুরও অতি সাধারণ রূপ ফুটিয়ে তুলতে পারে। একে বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং। এই আলোকবৃত্তের একাংশ উজ্জ্বল। উন্নত প্রযুক্তি এবং বহু বিজ্ঞানীর নিরলস প্রচেষ্টা ও সাধনার ফলে মানব সভ্যতা, এক সুবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি ও তার বাস্তব রূপ জানতে পেরেছে। আগামী দিনগুলিতে আমরা আশা রাখি এরকম আরো অনেক কৃষ্ণগহ্বরের ছবি আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে। কল্পবিজ্ঞানের কৃষ্ণগহ্বর এখন বাস্তব। তাকে না দেখা গেলেও ওই আলোর বৃত্তটি কৃষ্ণগহ্বরের ছায়া হিসেবে এক অদ্ভুত অচেনা জগৎকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। এত কিছুর পর বলাই যায়- এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

 

ছবি এবং ভিডিও কৃতজ্ঞতা স্বীকার-

National Geographic & (Chandra X-Ray Observatory)

                                        NASA’s flagship mission for X-Ray  Astronomy

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...