২০১৬-র রিও ডি জেনেরিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রথম ভারতীয় মহিলা এবং শেষ ৫২ বছরের মধ্যে প্রথম ভারতীয় জিমন্যাস্টের নাম দীপা কর্মকার।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। কিন্তু রিয়ো অলিম্পিক্সে জিমন্যাস্টিক্সে চতুর্থ হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন দীপা কর্মকার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষে ত্রিপুরার বাঙালি এই জিমন্যাস্টকে আচমকাই নির্বাসিত করে দিল আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিক্স সংস্থা। কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তা কিছুতেই বুঝতে পারেননি দীপা।
সেই মুহূর্তে আগরতলায় অনুশীলন করছিলেন দীপা। জাতীয় শিবিরের সদস্য নন তিনি। জানা গিয়েছে, আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিক্স সংস্থার সিদ্ধান্তে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, কোভিড অতিমারির কারণে দেশ-বিদেশের একাধিক যোগ্যতা অর্জন প্রতিযোগিতা বাতিল হয়ে যাওয়ায় টোকিয়ো অলিম্পিক্সে অংশ নিতে পারেননি দীপা। ফলে প্যারিস অলিম্পিক্সে খেলার জন্যে এই মুহূর্তে গভীর অনুশীলন করছিলেন তিনি। পাশাপাশি এ বছর এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসেও অংশ নিতেও মরিয়া ছিলেন।
২০১৬ সালের রিয়ো অলিম্পিক্সে দীপা আর প্রোদুনোভা ভল্ট প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার পরে চোট পাওয়ায় এই ভল্ট থেকে আপাতত দূরে সরে এসেছেন দীপা। গত কয়েক বছর ধরে আর প্রোদুনোভা ভল্ট দিচ্ছিলেন না রিয়ো অলিম্পিক্সে চতুর্থ হওয়া জিমন্যাস্ট। ইচ্ছে ছিল, অলিম্পিক্সের প্রস্তুতিতে আবার এই ভল্টকে ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু তা হয়নি। তাই অস্ত্র করেছিলেন নতুন ভল্টকে। কী সেই ভল্ট? তার কোচ বিশ্বেশ্বরবাবুর কথায়, ''স্ট্রেট বডি সমারসল্ট উইথ ৫৪০ ডিগ্রি টার্ন। প্রোদুনোভার বদলে এটাই দীপার নতুন অস্ত্র ছিলো। সঙ্গে পুরনো সুকাহারা ৭২০''।
প্রস্তুতির সময় এই নতুন ভল্টের সাহায্যে ফিরে আসার জন্য কতটা তৈরি ছিলেন দীপা? ভারতীয় জিমন্যাস্টিক্সকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া ২৭ বছর বয়সি এই মেয়ে তখন বলেছিলেন, ''এই ভল্টের সঙ্গে দারুণ ভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছি। স্যর যে ভাবে বলেছেন, সে ভাবে তৈরি হয়েছি। আমি এখন প্রতিযোগিতায় নামতে তৈরি''। কিন্তু এরপরের খবরে হটাৎ তাল কাটলো তার জীবনে চলার পথে।
প্রথম ভারতীয় মহিলা জিমন্যাস্ট হিসাবে ২০১৪ কমনওয়েলথ গেমসে মেডেল জিতেছিলেন দীপা কর্মকার। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে পদক জিততে না পারলেও তাঁর প্রদ্যুনোভায় মুগ্ধ হয়েছিল গোটা বিশ্ব। ২০১৯ সালে তাকে সম্মান জানিয়েছিল বিশ্বের জনপ্রিয় পুতুল প্রস্তুতকারক সংস্থা ম্যাটেল। সেই সময় বার্বি ডলের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দীপার আদলে বার্বি তৈরি করে তাঁকে সম্মান জানানো হয়। তিনিই হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যার প্রতিকৃতিতে তৈরি হয় বার্বি ডল। ১৯৫৯ সালে আমেরিকার সংস্থা ম্যাটেলের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে বার্বি। তারপর থেকেই দুনিয়া জুড়ে সকলের পছন্দের পাত্রী সে। বার্বির আত্মপ্রকাশের ৬০ বছর উপলক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সফল মহিলাদের সম্মান জানাতে 'মোররোলমডেল'নামের একটি ক্যাম্পেন শুরু করে তারা। সেই ক্যাম্পেনের অঙ্গ হিসাবে বার্বির নতুন ২০টি মডেল প্রকাশ করেছিল ম্যাটেল। সেখানেই বার্বি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ভারতীয় মহিলা জিমন্যাস্ট দীপা কর্মকার। বার্বির দীপাকে দেখা গেছে লাল রঙের জিমন্যাস্টের পোশাকে। সঙ্গে গলায় ঝুলছে ব্রোঞ্জ মেডেল।
একসময় বাবার হাত ধরে আগরতলার সাই সেন্টারে ভর্তি হতে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটা। যেখানে সব বিভাগে সেরা হওয়া সত্ত্বেও তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়। সেই এককালের বাতিল আর কান্নায় ভেঙে পড়া দীপা কর্মকার রিওতে বসে জেদ এবং স্বপ্নপূরণের পরে আরও বড় স্বপ্নের মিশেল নিয়ে বলেছিলেন, ''অলিম্পিক্সে সুযোগ পেয়েছি। আমার স্বপ্ন সফল। এ বার আমার টার্গেট রিও থেকে পদক। প্রত্যেকেই ভাল কিছু করার লক্ষ্যে নামে। আমিও নামব''। রিও অলেম্পিকের সময়ে দীপার এক সময়ের কোচ জয়প্রকাশ চক্রবর্তী বলেছিলেন, ''প্রোদুনোভা ভল্ট দিতে গিয়ে কতজনের যে কোমর ভাঙে! প্যারালিসিস হয়ে যায় শরীর! মেয়েদের জন্য তো আরও বিপজ্জনক। কিন্তু দীপা ওটাই দারুণ করে। বিশ্বে মাত্র জনাপাঁচেক মেয়ে এখন ওটা খুব ভাল করছে''।
২০১৮-র মেরসিন আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক বিশ্বকাপে সোনা পাওয়া দীপা কর্মকার ১৯৯৩ সালের ৯ আগস্ট ত্রিপুরার আগরতলায় জন্মগ্রহণ করেন। এর আগে ২০১৪-র গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমস এবং ২০১৫ তে জাপানের হিরোসিমায় হওয়া এশিয়ান জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছিলেন।
ছোট থেকেই বড্ড জেদী দীপা। মা গৌরী কর্মকারের কথায়, ''যেটা করবে ভাবত, করেই তবে শান্তি!'' তিনি একটা ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে জানান, গৌহাটিতে যে বার ন্যাশনাল গেমস হয়ে ছিল, সে বার দীপা গিয়েছিল খেলোয়াড় হিসেবে। আর ওর বাবা গিয়েছিল কোচ হিসেবে। দীপা সে বার কোনও মেডেল পায়নি। বাবার সঙ্গে আর দেখাও করেনি। সোজা ফিরে এসেছিল আগরতলায়। গৌরী দেবীর কথায়, ''আমাকে বলেছিল, মেডেল আমি আনবই।'' পরের ন্যাশনাল গেমসেই পাঁচটি সোনার মেডেল তুলে আনে দীপা।
তবে তাঁর সোনালি ভবিষ্যৎ গড়ার পিছনে বড় দিদির হয়তো তেমন কোনও ভূমিকা নেই। তবে পূজা কর্মকার না থাকলে আজকের দীপা কর্মকারও বোধহয় জন্মাতেন না! সালটা নব্বই দশকের মাঝামাঝি। দীপার বাবা দুলাল কর্মকার (যিনি আবার সাইয়ের ভারোত্তোলক কোচও) তখন তাঁর বড় মেয়ে পূজাকে জিমন্যাস্ট বানানোর স্বপ্নে বুঁদ। নিয়মিত যোগাসন, শরীর চর্চা সবই চলছে জোরকদমে। তবে মাস ছ'য়েক কাটতে না কাটতেই মোহভঙ্গ হয়ে যায় তাঁর। দুলালবাবু জানতে পারেন, পূজা নাকি শবাসন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ছে। এবং এটা এক দিনের ব্যাপার নয়, প্রায় রোজের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। স্কুলের পড়ার চাপ পূজার শেষ পর্যন্ত জিমন্যাস্ট হয়ে ওঠা হয়নি। বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করেন দীপা।
দীপার অবশ্য শুরুতে জিমন্যাস্টিক্সে তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। বরং লেখাপড়ার দিকেই বেশি ঝোঁক ছিল তাঁর। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রথম দশের মধ্যে র্যাঙ্ক করতেন স্কুলে। এমনকী রিওতেও নিয়ে গিয়েছিলেন পরীক্ষার নোটসগুলো। কেন না ফিরলেই এমএ পরীক্ষা তার।
২০১৭ সালের পদ্মশ্রী দীপা বাঙালির কাছে নতুন এক প্রেরণার নাম। কিন্তু উল্কার মত তার আগমন ও চলে যাওয়া হলেও আকাশের ঐ আলোক বিচ্ছুরণ সবার মন ছুঁয়ে গেছিল।