দীনবন্ধু ও বঙ্কিমচন্দ্র: বন্ধুত্বের অমলিন আখ্যান

দীনবন্ধু মিত্র তাঁর 'নবীন তপস্বিনী' (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ) নাটকটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে, আর বঙ্কিম তাঁর 'মৃণালিনী' উপন্যাসটি দীনবন্ধুকে উৎসর্গ করেন। ইতিহাসের চোখে এটা তাঁদের পারস্পরিক বন্ধুতা ও প্রীতির একটি নিদর্শনমাত্র। 



কিন্তু, এই 'বন্ধুত্ব' সূচিত হয়েছিল নেহাত কৈশোরকালে, অবধারিতভাবে এবং নিতান্তই পত্রযোগে। যাকে বলে, 'পত্র-মিতালি'; তাই-ই ছিল এই মিত্রতার সেতু। মিত্রতা প্রগাঢ় ও নিখাদ হয়েছিল পত্রে-পত্রেই। তবে বন্ধুতা অবিচ্ছিন্ন ছিল, আন্তরিকতাময় ছিল আমৃত্যু পর্যন্ত।



যাই হোক, শুরুর কথা শুরু থেকেই বলি:



দীনবন্ধুর বাবা কালাচাঁদ মিত্র পরিবারে কিছুতেই সচ্ছলতা আনতে পারেননি, তাই বাধ্য হয়েছিলেন আপন মামাবাড়ি চৌবেড়িয়াতে আশ্রিত হয়ে থাকতে। তবে বংশের ধারারক্ষায় তাঁর কোন খামতি ছিল না। তাই অনেকগুলি ভাইবোনের মাঝে এখানেই একদিন দীনবন্ধুর জন্ম হয়েছিল।

 

Dinabandhu1

নিজে সমর্থ না-হলেও বালক-পুত্রকে সংসারের হাল ফেরানোর কাজে লাগাতে কালাচাঁদের ত্রুটি রইল না। তিনি গাঁয়ের পাঠশালায় ছেলেকে জমিদারি হিসেব-নিকেশের ধারাটুকু শিখিয়ে একে-ওকে ধরে একদিন এক জমিদারের সেরেস্তায় দিলেন গছিয়ে। ব্যস, বাল্যেই শুরু হয়ে গেল দীনবন্ধুর মাসমাইনের কর্মজীবন।



না, বাবার এই সিদ্ধান্ত দীনবন্ধুর মোটেই পছন্দ হল না। তিনি আরও পড়তে চান, ইংরেজি শিখতে চান, বাংলাভাষায় লিখতে চান। তাই চাপে পড়ে বাবার দেওয়া কাজে যোগ দিলেও রামপ্রসাদের মতো তাঁরও মন উচাটন হল।



বাবার দেওয়া আর একটি জিনিস দীনবন্ধুর একেবারেই পছন্দ ছিল না, সেটি হল 'নাম'। বাবা তাঁর নাম দিয়েছিলেন, 'গন্ধর্বনারায়ণ'। এটিই ছিল তাঁর আদি এবং একমাত্র নাম। 



কিন্তু ওই নামের জন্যই গ্রাম্যজীবন হয়ে উঠেছিল দীনবন্ধুর কাছে ভয়ানক অতিষ্ঠকর। কেননা, গাঁয়ের বখাটে ছেলেরা তাঁর পেছনে লাগার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল এই নামের জন্যই। তিনি পথে বেরলে তারা 'গন্ধর্ব'-কে 'গন্ধ' করে নিয়ে তাঁর পেছনে সমস্বরে যখন বলতে বলতে আসত 'থু থু গন্ধ, গন্ধ'; তখন এই নামের দরুন দারুণ অপমানিত হয়ে তাঁর এমন কান্না পেত যে, প্রতিবাদের কথাও মাথায় আসত না! কাজেই, 'গন্ধর্বনারায়ণ' নাম নয়, তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল নিছক দুর্বিষহ এক বোঝা।



দীনবন্ধুর ক্রমে ক্রমে মনে হতে লাগল, নাম আর সেরেস্তার বদ্ধজীবন দুই থেকেই মুক্তি পেতে তাঁকে পালাতে হবে। কোথায় পালাবেন? রূপকথার গল্পের মতো মন বলল, যে-দিকে দু'চোখ যায়!

 

Dinabandhu2

ভাগ্যিস, 'কখনই পিতামাতার অবাধ্য হওয়া উচিত নয়' যুগবাহিত নীতিবাক্য তাঁর পথ আটকে দাঁড়াল না। তাই তিনি সটান পালাতে পালালেন। দু'চোখ গেল মহানগরে। সুতরাং, বাড়ি থেকে গোপনে পালিয়ে হাজির হলেন মোকাম কলকাতায়। 



কলকাতায় খুঁজে খুঁজে উঠলেন এসে এক জ্ঞাতির বাসায়। হলেন আশ্রিত। হেঁশেলের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে, তার কাজ সমাধা করে বাকি সময়টুকুতে শুরু করলেন স্বপ্নের সন্ধান।



স্বপ্নের সন্ধানে নেমে প্রথমেই তিনি নিজের গা থেকে 'গন্ধর্বনারায়ণ' নামের বিভীষিকাটিকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। নিজেই নিজের নাম দিলেন, 'দীনবন্ধু'। তারপর নিজেকে সটান ভর্তি করলেন এক ইংরেজি স্কুলে। স্কুলের নাম, কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল। সেখানে জেমস লঙের মতো শিক্ষকরা তাঁর অসহায় দারিদ্র্যের কথা শুনে বইপত্রাদি দিয়ে সাহায্য করার আশ্বাস দিলেন। শুরু হল স্বপ্নের জীবন। অবসরে চলতে লাগল সাহিত্যচর্চাও।



সাহিত্যে তখন আধুনিকতার ধ্বজা ওড়াচ্ছিলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। সেই ধ্বজায় হাওয়া জোগাচ্ছিল তাঁর 'সংবাদ প্রভাকর' ও 'সংবাদ সাধুরঞ্জন' পত্রিকা। এই তিনের অনুপ্রেরণায় হবু-কবিদের কাছে সেই সময় ঈশ্বর গুপ্ত হয়ে উঠেছিলেন অনুসরণীয় সাহিত্য-গুরু এবং তাঁর পত্রিকাদ্বয় হয়ে উঠেছিল নবীন সাহিত্যিকদের আশ্রয়। দীনবন্ধুও এর বাইরে রইলেন না। একদিন তাঁরও একটি কবিতা প্রকাশিত হল 'সংবাদ সাধুরঞ্জন' পত্রিকায়। কবিতার নাম, 'মানব-চরিত্র' :

'মানব-চরিত্র-ক্ষেত্রে নেত্র নিক্ষেপিয়া।

দুঃখানলে দহে দেহ, বিদরয়ে হিয়া।।'



যুগটা ছিল সহজ কথা সহজ ভাবে সহজ ভাষায় সোচ্চারে বলার যুগ। দীনবন্ধুর কবিতায় সেই সোচ্চার-সরলতা ছিল। পত্রিকাটি বালক বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে পড়তে এই সরলতাই হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। শুধু তাই নয়, কবিতাটি তাঁকে বার বার পড়তে বাধ্য করল। বঙ্কিমও তখন কবিতা লেখেন 'প্রভাকর'-এর পাতায়। পাঠসূত্রে এভাবেই এক কবির সঙ্গে আর-এক কবির অন্তর মিলল। কবিতাটি তাঁর হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গেল যে, কবিকে সাধুবাদ জানাতে দারুণ উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। অমনি 'গুপ্ত-কবি'র কাছ থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে লিখে ফেললেন চিঠি।


Dinabandhu3

অচিরেই চিঠি তৈরি করল সেতু। বন্ধুত্বের সেতু। উভয়ে উভয়ের কবিতা পড়লেন। অনুরাগী হলেন। আলাপ চলতে লাগল পত্রে। বন্ধুত্বের এই লালনকালটি সম্পর্কে বঙ্কিম-সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর  

'বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনবন্ধু' নামের স্মৃতিতে লিখেছেন:



'উভয়েই কবিতা লিখিতেন। কখনও দেখাশুনা নাই, চোখাচোখি নাই, পত্রের দ্বারা এই সময় ইহাদের বন্ধুত্ব জমিল।।সর্বদাই উভয়ে উভয়কে পত্র লিখিতেন, কখনও কখনও পত্রের ভিতর কবিতা থাকিত, আদরের কবিতা কখনও গালাগালির কবিতা থাকিত।' এমনি করে বন্ধুত্বকে লালন করতে করতেই কেটে গেল বহু বহু দিন।



তারপর একদিন দু'জনের সাক্ষাৎ হল। তখন দু'জনের মনেই হল না যে, এ-তাঁদের প্রথম দেখা। অন্তরদর্শন হয়ে গেলে সাক্ষাতে শুধু প্রীতির পরত বাড়ে, আলাপের আর অবশিষ্ট থাকে না। তাঁদের নির্মল বন্ধুত্ব ততদিনে স্তরেই উন্নীত। ফলে সেই বন্ধুত্বের সেতু বেয়ে দু'জনেই দু'জনের ব্যক্তিজীবনের আধারে প্রবেশ করতে দেরি করলেন না। এমনকি বিবাহের মতো একান্ত ব্যক্তিগত বলয়েও।



দীনবন্ধু বিয়ে করেছিলেন বাঁশবেড়িয়ায়। বঙ্কিমের প্রথম স্ত্রী গত হলে, তিনি যখন দ্বিতীয় বিবাহে উদ্যত হলেন, তখন পাত্রী দেখায় সঙ্গী করলেন সেই দীনবন্ধুকেই। এবং, বোট ভাড়া করে বহু ঘাট ঘুরে শেষমেশ বন্ধুর শ্বশুরবাড়ির স্থানে অর্থাৎ বাঁশবেড়িয়াতে এসেই তাঁর পাত্রী পছন্দ হল। এবং, সেখানেই বিয়ে করলেন।



ততদিনে কবিতা ছেড়ে বঙ্কিম ঝুঁকেছেন উপন্যাসে আর দীনবন্ধু আশ্রয় নিয়েছেন নাটকে। বঙ্কিমের এই বহু অনুসন্ধানে পাত্রী দেখার অনুষঙ্গটি মজা করে তাঁর 'নবীন তপস্বিনী' নাটকে আনলেন দীনবন্ধু। শুধু আনলেনই না, বন্ধুকে নাটকটি উৎসর্গও করলেন।



বঙ্কিম ও দীনবন্ধুর এই যে বন্ধুত্ব, এতে নিখাদ আন্তরিকতার সঙ্গে ছেলেমানুষিও কম ছিল না। এই নিয়ে একটা মজার ঘটনা বলি:



বঙ্কিমের বাড়িতে সেদিন আড্ডার আসর বসেছে। তাতে যথারীতি দীনবন্ধুও হাজির। তবে তিনি সেদিন বঙ্কিমের পেছনে লাগার প্ল্যান নিয়েই এসেছেন। এসেই  কাগজে বঙ্কিমের হোৎকা ভুঁড়িওয়ালা একখানা ছবি এঁকে রঙ্গ করে তার নীচে দু'লাইনের আঁত জ্বালানো ছড়াও লিখে ফেলেছেন। ছবি দেখে ও ছড়া পড়ে উপস্থিত সকলের হো হো হাসি যেন আর থামতেই চাইছে না! আড়চোখে বঙ্কিম শুধু একবার বস্তুটি দেখলেন, কিন্তু সকলের সঙ্গে হাসলেন না। তাতেই আরও তামাশা উঠল জমে। 



ফলে, ব্যাপারটার একটা সদুত্তর দিতে বঙ্কিম একেবারে উচাটন হয়ে উঠলেন। কাগজ টেনে তিনিও দীনবন্ধুকে নিয়ে কয়েক লাইন রঙ্গকথা লিখে সাঁটিয়ে দিলেন একেবারে দীনবন্ধুর পিঠে। তাতে যেন আর সকলের চেয়ে আমোদ পেলেন দীনবন্ধুই। তিনি সকলের দিকে পিঠ ফিরিয়ে লেখাটি পড়াতে পড়াতে বলতে লাগলেন, তোমারাই বলে দাও কী লেখা আছে এতে, ওহে হাতি যে পিঠে মশা বসলে দেখতে পায় না! যেই না সে-কথা বলা অমনি সুযোগ পেয়ে জ্বলে উঠল বঙ্কিমের উইট, বললেন, ওই জন্যই তো হাতিকে 'হস্তীমূর্খ' বলে! অমনি সকলেই আবারও হো হো করে হেসে উঠলেন। এবং, তাতে যোগ দিলেন দীনবন্ধুও।



রসিক দীনবন্ধু খোঁচা খেয়েও রাগ করতেন না। তাঁর এটি একটি বড় গুণ ছিল। সে-কথা স্মরণ করে বঙ্কিম তাই 'রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী ও কবিত্ব সমালোচনা' নামক রচনায় লিখেছেন, "মনুষ্য মাত্রেরই অহঙ্কার আছে, দীনবন্ধুর ছিল না। মনুষ্য মাত্রেরই রাগ আছে, দীনবন্ধুর ছিল না। দীনবন্ধুর কোন কথা আমার কাছে গোপন ছিল না, আমি কখন তাঁহার রাগ দেখি নাই।"



বঙ্কিম ও দীনবন্ধুর এই যে নিষ্কলুষ বন্ধুত্ব, তা শেষ হয়েছিল দীনবন্ধুর অকালমৃত্যুতে। সেই মৃত্যু বঙ্কিমকে যে কতটা আঘাত করেছিল, কতটা রিক্ত করেছিল, তা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর 'বঙ্গদর্শনের বিদায় গ্রহণ' প্রবন্ধে:



'আমার আর একজন সহায় ছিলেন, সাহিত্যে আমার সহায়, সংসারে আমার সুখ-দুঃখের ভাগী, তাঁহার নাম উল্লেখ করিব মনে করিয়াও উল্লেখ করিতে পরিতেছি না। এই বঙ্গদর্শনের বয়:ক্রম অধিক হইতে না হইতেই, দীনবন্ধু আমাকে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার জন্য তখন বঙ্গসমাজ রোদন করিতেছিল, কিন্তু এই বঙ্গদর্শনে আমি তাঁহার নামোল্লেখ করি নাই কেন, তাহা কেহ বুঝে না। আমার যে দুঃখ, কে তাহার ভাগী হইবে। কাহার কাছে দীনবন্ধুর জন্য কাঁদিলে প্রাণ জুড়াইবে। অন্যের কাছে দীনবন্ধু সুলেখক, আমার কাছে প্রাণতুল্য বন্ধু...।'



অমোঘ বিচ্ছেদের এই বেদনা বঙ্কিম বয়ে বেড়িয়েছেন সারাজীবন, ধরে রেখেছেন তাকে স্মৃতির সুরভি দিয়ে। শতবর্ষের ইতিহাস পেরিয়ে বন্ধুত্বের আখ্যানমালায় তার সৌরভ তাই রয়েছে আজও অমলিন...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...