রাসকথা পর্ব-২ : বঙ্গের নানা রূপের রাসযাত্রা

গোটা বঙ্গে নানান রূপে রাস পালিত হয়। তার মধ্যে কয়েকটি অঞ্চলের রাস বিশেষ খ্যাতি পেয়েছে। যেমন-

41 (1)

শান্তিপুরের রাস:

শান্তিপুরের রাসই বাংলার সর্বাধিক জনপ্রিয় রাস। বৃন্দাবনে যখন শ্রীকৃষ্ণ রাসলীলা করতে রাজি হলেন, তখন তিনি শর্ত দিয়েছিলেন রাসমঞ্চে একমাত্র পুরুষ হিসেবে তিনিই থাকবেন। শর্ত মেনে শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত অন্য কোন পুরুষ রাসমঞ্চে ছিলেন না। দেবাদিদেব মহাদেব ভাবলেন কী এমন আছে রাস লীলায, যে কোনও পুরুষকে তা দর্শন করতে দেবেন না কৃষ্ণ। তিনি ঠিক করলেন তিনি রাসলীলা দর্শন করতে যাবেন। সেই মতো মহাদেব নারীর ছদ্মবেশে রাসমঞ্চে প্রবেশ করেন। অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারেন দ্বিতীয় পুরুষের আগমন ঘটেছে, তৎক্ষণাৎ শ্রীকৃষ্ণ রাস মঞ্চ ত্যাগ করেন। এই ঘটনায় মহাদেব ক্ষুন্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে বলেন, তিনি কলিযুগে আচন্ডাল ভক্তকে রাসলীলা দর্শন করাবেন। এরপর কলিযুগে মহাবিষ্ণুর অবতার রূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হলেন কমলাক্ষ মিশ্র। মহাবিষ্ণু অর্থাৎ মহাদেব এবং বিষ্ণুর মিলিত রূপে তিনি শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্য রূপে প্রকট হন। তিনিই সর্বপ্রথম রাস উৎসবের সূচনা করেন।

সেই রাস উৎসব জনসাধারণের উৎসবে পরিণত হয় আজ সমস্ত ভক্ত এই উৎসব দর্শন করতে পারেন। শান্তিপুরের থেকে নবদ্বীপেও রাস উৎসবের সূচনা হয়। নবদ্বীপে তন্ত্র সাধনারও আধিক্য ছিল, তাই সেখানে রাস উৎসবে শক্তির ও আরাধনা হত। নবদ্বীপ থেকে আস্তে আস্তে শান্তিপুরেও রাস শাক্ত এবং বৈষ্ণবের মিলন উৎসবে পরিণত হয়।

প্রথমে শান্তিপুরে রাস উৎসব ছিল দুদিনের। প্রথম রাস এবং দ্বিতীয় রাস বা মাঝের রাস। শান্তিপুর বড় গোস্বামী বাড়ির কূলবিগ্রহ রাধারমন অর্থাৎ পুরীর দোলগোবিন্দ তৎকালীন সময়ে মন্দিরে একাই পূজিত হতেন। রাধারানী ছিলেন না। তখন মাঝে মাঝেই শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ হারিয়ে যেত বা অপ্রকট হত। কাত্যায়নী মায়ের আরাধনার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ ফিরিয়ে আনা হত। কিন্তু একটা স্থায়ী সমাধানের বড্ড প্রয়োজন ছিল। তখন শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্যরা ভাবলেন, রাধারানীকে আনলে হয়ত কৃষ্ণের সংসারে মন বসবে, তিনি আর মন্দির ছেড়ে আর কোথাও যাবেন না। রাধারানীর মূর্তি গড়িয়ে রাস উৎসবের সময় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই বছর দ্বিতীয় রাসের পরদিন, শান্তিপুর বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্যরা রাধা এবং কৃষ্ণের মূর্তি যুগলকে নগরবাসীকে দর্শন করানোর জন্যে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আয়োজন করেন। শান্তিপুরের অন্যান্য বাড়ির বিগ্রহ সেই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। ঠিক যেন রাধা-কৃষ্ণ হচ্ছেন বর বউ আর বাকি সবাই বরযাত্রী। এইভাবেই ভাঙারাসের সূচনা হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর ভাঙারাস আয়োজিত হচ্ছে। রসভঙ্গ হল রাস উৎসবের শেষ, তাই একে ভাঙারাস বলা হয়।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভাঙা রাস দেখার আগ্রহ বাড়তে থাকে। কৃষ্ণচন্দ্র রাসের সময় নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর আসার জলপথ এবং স্থলপথের কর অসম্ভব ভাবে বাড়িয়ে দেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই করের ভার বহন করা সম্ভব ছিল না। ফলে শান্তিপুরের ভাঙারাসের ভিড় কমতে থাকে। অন্যদিকে, নবদ্বীপে ভিড় বাড়তে থাকে। শান্তিপুরের ভাঙারাসের হৃতগৌরব পথ বাতলানো হয়, এবার থেকে বিগ্রহের সঙ্গে বেরোবেন রাইরাজা। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ যখন রাস মঞ্চ ত্যাগ করেছিলেন, তখন স্বয়ং রাধারানী রাজা সেজেছিলেন। রাজবেশে তিনিই রাসলীলা সম্পূর্ণ করেছিলেন। সেই ঘটনার প্রতীক হিসাবে কুমারী মেয়েকে রাজা সাজিয়ে বিগ্রহের সামনে সিংহাসনে বসিয়ে, ভাঙারাসের শোভাযাত্রা শুরু হয়। এই অভিনব জিনিস দেখতে ফের শান্তিপুরের ভাঙারাসে ভিড় জমতে শুরু করে। আজও রাইরাজার সেই ঐতিহ্য চলে আসছে।​​

06fc08119214f0c2d501a0271399_grande-732379

নবদ্বীপের শাক্ত রাস:

রাস নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ উৎসব। নবদ্বীপের রাস অনন্য। চৈতন্যজন্মভূমি নবদ্বীপের রাস বৈষ্ণবদর্শনে রাসের পুরোপুরি উলোট পুরাণ। কার্তিক পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ লোকায়ত উৎসব রাস। এখানকার রাসের প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে মূর্তির বিশাল অতিকায় আকার। নানানরূপে শক্তি আরাধনাই নবদ্বীপের রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাস মূলতঃ কৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত উৎসব। যদিও নবদ্বীপের রাস মূলত শাক্ত ভাবধারা আশ্রিত। আবহমানকাল থেকে এখানকার ধর্ম-সংস্কৃতিতে তন্ত্রের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কালী এখানকার অন্যতম আরাধ্যা দেবী। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের কথা ভুললে চলে না। তিনিই কালীর রূপ দিয়েছিলেন। এখানকার কালী পুজোয় পঞ্চ 'ম'-এর ব্যবহার হয়।

স্বভাবতই নবদ্বীপের রাসে তন্ত্রাচারের পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়। পূর্ণিমার রাতে, বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শক্তিমূর্তির পুজোই হল নবদ্বীপের রাস। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে অনুমানিক ১৭২৮-৮২ সময়কালের মধ্যে নদীয়ায় রাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল। রাজা হওয়ার পর থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন। তারপর থেকেই তিনি মঠমন্দির স্থাপন, মেলা উৎসবের সূচনা বা বহু জনকল্যাণমূলক কাজ শুরু করেন। ১৭৫৩-৫৬-র মধ্যে তিনি জগদ্ধাত্রীপুজো, বারোদোলের সূচনা করেন। মনে করা হয়, ওই সময় তিনি নবদ্বীপের বৈষ্ণবদের রাসের খোলনলচে বদলে দেন। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন শাক্ত। নদিয়া, অগ্রদ্বীপ, কুশদ্বীপ এবং উলা এই চারটি সমাজের সমাজপতি। শক্তিসাধনা প্রচারে তার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। তিনিই রাসপূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে শক্তিমূর্তি পুজোর প্রচলন করেন, উৎসাহিত করতে আরম্ভ করেন। রাজ অনুগ্রহেই বৈষ্ণবীয় রাসকে ছাপিয়ে যায় শাক্ত আরাধনা।

madan-mohan-mandir-Anwesha-Banerjee

কোচবিহারের মদনমোহনের রাসযাত্রা:

কোচবিহারের মদনমোহনের রাসের মেলা জগৎ বিখ্যাত। শোনা যায়, ভৌতিক উপদ্রবে অতিষ্ট হয়ে কোচবিহারের মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ ভেটাগুড়িতে চলে আসেন। রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সময়কালে আসাম থেকে এখানে এসেছিলেন বৈষ্ণব গুরু শঙ্করদেব। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে এসে তিনি বলেন, শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গে রাধারানি বলে কিছু হয় না। আসলে একই অঙ্গে তাঁর দুই রূপ। এই ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছে কোচবিহারের মদনমোহন বিগ্রহ। ১৮১২ সালে কোচবিহারের ভেটাগুড়িতে প্রথম রাসমেলার আয়োজন করা হয়। সে বছর রাসপূর্ণিমা তিথিতে কোচবিহারের মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ ভেটাগুড়িতে নব নির্মিত রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন। সেই উপলক্ষ্যেই রাসমেলার আসর বসে। তারপর ১৮৯০ সালে কোচবিহারের বৈরাগী দিঘির পাড়ে মদনমোহন মন্দির নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়। আকৃতিতে মন্দিরটি চারচালা। মদনমোহন আদপে কোচবিহারের মহারাজের গৃহদেবতা। রুপোর সিংহাসনে অষ্টধাতুর মদনমোহন বিরাজ করেন।
১৮১২ সালে রাসপূর্ণিমার দিন মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ সন্ধ্যাবেলায় মানসাই নদী পেরিয়ে নতুন রাজধানী ও রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন এবং সেখানেই গৃহদেবতা মদনমোহনের রাসমেলার সূচনা করেন। সেদিনই প্রথম রাসের মেলা বসেছিল। পরে কোচবিহারের রাজপ্রাসাদ এলাকায় মেলা স্থানান্তরিত হয়। কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরে মোট পাঁচটি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে একটি করে দেবী বিগ্রহ রয়েছে। ১৯১৭ সাল নাগাদ প্যারেড গ্রাউন্ডে মেলা স্থানান্তরিত হয়, অধুনা যা রাসমেলার মাঠ নামেই পরিচিত। আয়তনে বড় হতে থাকে মেলা। ১৯২৮ সালে মেলায় প্রথম বিদ্যুতের আলো ব্যবহার করা হয়। ২০১২ সালে কোচবিহারের রাসমেলার দুশো বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯২৩ সালে কেবল এক বছরের জন্যই মেলা বন্ধ ছিল। শহরজুড়ে কলেরা ছড়িয়ে পড়ায় মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতি বছর মদনমোহন মন্দিরে রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। তারপর ওই রাসচক্র ঘোরানোর সুযোগ পাবেন দর্শনার্থীরা। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কোচবিহারের মহারাজারা ওই রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা করেছেন। এখন কাজটি করেন জেলাশাসক।

কোচবিহারের রাসচক্র যেন ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলে। বংশানুক্রমিকভাবে রাসচক্র তৈরির কাজের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন কোচবিহার শহর লাগোয়া হরিণ চওড়ার এক মুসলিম পরিবার। লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে চক্র গড়ার কাজ শুরু হয়। বাঁশ কেটে বাতা তৈরি করে শুকিয়ে কাগজের কারুকাজ, পাট দিয়ে গড়া দেবদেবীর ছবি আটকানো হয়। ২২ ফুট উঁচু কোচবিহারের রাসচক্র যেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক।

দাঁইহাটের শাক্ত রাস:

কালীর সঙ্গে কৃষ্ণ, শাক্তের সঙ্গে বৈষ্ণবের মেলবন্ধনের সাক্ষী গঙ্গাপাড়ের জনপদ দাঁইহাট। ১৫০০ সালে পর থেকে নবীন ভাস্করের শহরে রাস উৎসবের সূচনা হয়। এই নবীন ভাস্করই বাংলার একাধিক জনপ্রিয় কালিমূর্তির নির্মাতা। ঐতিহাসিকেরা বলেন, দাঁইহাট, নবদ্বীপ, শান্তিপুরে রাস উৎসবের এককালে মূর্তিপুজো হত না। তান্ত্রিক সাধকরা কালীঠাকুরের পট তৈরি করে পূর্ণিমার দিন শোভাযাত্রা করতেন। এলাকার বাসিন্দারা তাঁদের ‘পটুয়া তান্ত্রিক’ বলতেন।

১৯৫১ সালে দাঁইহাটে পট নিয়ে শেষ শোভাযাত্রা হয়। পাতাইহাটের কবিরাজ ও সাধক পূর্ণচন্দ্র আচার্য সেই শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দাঁইহাটের রাসযাত্রায় শাক্তদের পাশাপাশি বৈষ্ণবদের যোগদানও লক্ষণীয়। তবে এখানকার রাস উৎসবে কালীপুজোই বেশি হয়। শবশিব, বড়কালী, কায়েতকালী, গণেশ জননী, উগ্রচণ্ডী, কাত্যায়নী, আনন্দময়ীর পুজোও চলে। দাঁইহাটবাসী রাজবংশী সম্প্রদায়ের উপাস্য শবশিবকে খুব জাগ্রত মনে করেন। রাজবংশী তন্ত্রসাধক ভগীরথ সিংহ শবশিব আরাধনার সূচনা করেন। চৈতন্যের পথ ধরে শাক্তদের সরিয়ে বৈষ্ণব ঘরানার রাস দাঁইহাটের প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে। বর্তমানে বৈষ্ণব রাসেরই রমরমা।

আরও জানুন রাসকথা উৎসব সম্পর্কে : পর্ব - ১

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...