বলতে দ্বিধা নেই সাইকেল বিশ্বের বিস্ময়। কারণ এই যানটি স্টেটাসগত বিভাজন আপেক্ষিক ভাবে দূরীকরণে সক্ষম। সমাজের শ্রেণী নির্বিশেষে এর প্রয়োজন খানিক ভিন্ন হলেও চাহিদা নিরবচ্ছিন্ন। আর এই বাহনটি চালাতে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় না, দাম মারাত্মক কিছু নয়। আবার পরিবেশ বান্ধব - যার প্রয়োজনীয়তা বেশি। যে কোনো রাস্তায় উপযোগী। উনিশ শতকের ইউরোপ ছিল সাইকেলের স্বর্ণযুগ। আজ আধুনিক যানের প্রভাবে বাইসাইকেল খানিক তার স্টেটাস হারালেও ক্রমাগত পুরোনো কে যেমন নতুনের মোড়কে আবার ফেরানো হচ্ছে তেমন এই সাইকেলের চাহিদাও তার নিজ গুনেই স্বমহিমায় বিদ্যমান থাকবে। বড় রাস্তায় তার দেখা না মিললেও মফস্বলে নিয়মিত ও এখনো কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় কাগজওয়ালা, দুধওয়ালার সৌজন্যে নিয়মিত এই যানটির দেখা মেলে। কিন্তু এই সাইকেল প্রথমদিকে বিত্তশালীর করায়ত্ত হলেও তাকে সাধারণের আয়ত্তে যিনি আনেন তিনি এক বাঙালি। আজ সেই তথ্যই দেবো ।
সর্বপ্রথম১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় নতুন এক গাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়। এক্কেবারে ভিন্ন এক ধরণের, যা চালাতে কারোর উপর নির্ভর করতে হয়ে না। নাম - সাইকেল, শুধু সিটের উপর বসে পা দিয়ে হেঁটে চালালেই হলো। চাকার গতি আত্মস্থ হওয়া শুরু হলো। জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে বেশ জনপ্রিয় হলেও শেষপর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ি ও পথচারী মানুষের জন্য বিপজ্জনক বলে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় জনসন ও ডাইসিনের এই সাইকেল।
তবে ততদিনে এই সাইকেল পৃথিবীব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছে। কিন্তু আরো স্বাচ্ছন্দ্য এবং গতির মেলবন্ধনে সাইকেল নির্মাতারা আরো উন্নত প্রযুক্তির সন্ধান করতে থাকে। ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে ১৮৬৯ সালে ‘এডুকেশন গেজেট’ ‘ভেলোসিপেড’ নামক এক যন্ত্রের কথা প্রকাশ করে। আরো জানা যায়, যে ফ্রান্সের পুরুষরা চালায় দুই চাকার ভেলোসিপেড, আর মহিলারা তিন চাকার। ইতিমধ্যেই স্ব- বাহনটি যে ফ্রান্সে জনপ্রিয়তার নিরিখে শীর্ষস্থান দখল করে তা বলাই বাহুল্য।
এই সংবাদ প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় সাইকেলের আগমন ঘটে বিত্তশালী ব্যক্তিকুলের হাত ধরে। যদিও তা সাধারণের ধরা ছোয়াঁর বাইরে। তার মূল্য খানিক বেশি। আর ইতিমধ্যেই তাকে সাধারণের আয়ত্তাধীনে আনতে এক বাঙালির উদ্যোগ প্রশংসনীয়। ইনি হলেন সাঁতরাগাছির প্রসন্ন কুমার ঘোষ। তিনি উদ্যোগী হন এক অভিনব সাইকেল নির্মাণে এবং তাঁর নির্মিত সাইকেলটি সামনে একজন এবং পশ্চাতে দুইজন পা দিয়া চাকা ঘোরালেই চলতে থাকে। এই সাইকেলের নাম ছিল ‘ট্যান্ডেম’। কিছুদিনের মধ্যেই এই খবর জনসমক্ষে আসে ‘সুলভ সমাচার’ সৌজন্যে। ওই একই সময়ে কলকাতায় জনপ্রিয় ছিল পেনি-ফার্দিং সাইকেল। প্যাডেল দেওয়া এই সাইকেলের সামনের চাকা ছিল অতিকায়, আর পিছনের চাকা ছোটো। ইন্দিরা দেবীর লেখায় কলকাতার রাস্তায় পেনি-ফার্দিং এর বর্ণনা পাওয়া যায়।
১৮৮৫ সালে ব্রিটেনে কেম্প স্টার্লি তৈরি করেন প্রায় আধুনিক সাইকেলের মতো ‘সেফটি বাইসাইকেল’। কলকাতার অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেও সাইকেল বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আর প্রথমবার তেমন অত্যাধুনিক সাইকেল প্রত্যক্ষ করে কলকাতাবাসী ১৮৮৬ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর- ওই দিন সাইকেলে চড়ে কলকাতায় আসেন টমাস স্টিভেন্স। তিনি তাতে চড়েই বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তাঁকে দেখতে ময়দানে ভিড় জমায় ছেলে-ছোকরার দল। শহর জুড়ে সেদিন সে এক হুলুস্থুলু দশা।
শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ সাইকেলে চড়ে চৌরঙ্গী অঞ্চলে হাওয়া খেতে যেতেন। ১৮৯৭ সালে কলকাতাতে তৈরি হয় ‘সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’। ১৯০৩ সালে বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্র মোহন বসু তৈরি করেন ‘এইচ বোস অ্যান্ড কোং সাইকেলস’। হেমেন্দ্র মোহনের কাছেই সাইকেল চালানো শিখেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, তাঁর স্ত্রী অবলা বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, নির্মলা দেবী। দেখতে দেখতে আভিজাত্যের সীমানা ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে যায় সাইকেল। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রভাবে সারা পৃথিবীর মতোই কলকাতাতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাইসাইকেল। যাই হোক আজকাল ট্রাফিকের ভিড়ে সাইকেল কলকাতার রাজপথে ব্রাত্য হলেও জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি। এর অবদান কিন্তু সেই দুই বাঙালির - আজ না হয় তাঁদের স্মৃতিচারণ হোক।