বৈচিত্রের তিলোত্তমার বিচিত্র খাওয়া দাওয়া

বড়দিন মানেই বো ব্যারাক; কিন্তু বো ব্যারাক মানেই কেক বা হোমমেড ওয়াইন নয়! বো ব্যারাকের মধ্যেই আছে আরও এক অজানা ইতিহাস। এই চত্বর মানেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খানা নয়! এখানে লুকিয়ে আছে পার্সি খানার স্বর্গরাজ্য। পার্সিদের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অবশ্য আজকের নয়। বম্বেওয়ালা, পুনাওয়ালার মতো 'বেঙ্গলি' পদবীধারী পার্সিও কম দেখা যেত না! প্রথম বাংলা ছবি 'জামাইষষ্ঠী'র প্রযোজক ম্যাডান থিয়েটার্সের স্মৃতি মিশে ম্যাডান স্ট্রিটে। উনিশ শতকের গোড়ায় খিদিরপুরের ডকটাই কিনে নেন রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি। থাকতেন আজকের গড়পারের পাশে। এককালে যেখানে রুস্তমজি কাওয়াসজীর বাগান বাড়ি ছিল বলে, ওই অঞ্চলের নাম হয়েছে পার্সিবাগান। ত্রিসীমানায় পার্সিরা নেই, তবু সেই পাড়া পার্সিবাগান বলেই লোকে আজও চেনে। আজও মেটাকাফ লেনে রয়েছে পার্সিদের উপাসনা স্থল।

 

foods1

৯ নম্বর বো স্ট্রিট, একটা বাড়িতে, সেই বাড়ির উপরেই শ্বেতপাথরের ফলকে জ্বলজ্বল করে, 'মানাকজি রুস্তমজি ধর্মশালা ফর পার্সি ট্র্যাভেলার্স'। আজ্ঞে হ্যাঁ, পার্সিদের জন্যই তৈরি হয়েছিল এই ধর্মশালা। কলকাতায় আসা পার্সি সম্প্রদায়ের অতিথিদের যেন আশ্রয়ের অভাব না হয়। ১৯০৯ সালে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ধর্মশালাটি, পরে ১৯৩৬ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। কলকাতার প্রথম ভারতীয় শেরিফ ছিলেন মানেকজি রুস্তমজি। মনে করা হয়, তাঁর নামেই এই ধর্মশালার নামকরণ করা হয়েছে। এক সময় কলকাতায় বিপুল সংখ্যক পার্সিদের বসবাস ছিল। তদানিন্তন বোম্বেতেও এমন অতিথিনিবাস তৈরি হয়েছিল। পকেটবান্ধব খরচ ছিল ইউ এস পি! মানেকজি রুস্তমজি ধর্মশালার পাকশালা এই শহরকে পার্সি খাবারের নেশা ধরিয়েছে।

পার্সি খাবার বলতেই ধনশাকের কথা চলে আসে। ধনশাক হল পার্সিদের ডাল-ভাত। ধনশাক হল শোকের অনুষ্ঠানের খাবার। পার্সি পরিবারে কেউ মারা গেলে প্রথম কয়েক দিন মাংস খাওয়া যায় না। তারপর ধনশাকের মাধ্যমে মাংস খাওয়া শুরু হয়। সাধারণত চার রকম ডাল অড়হর, চানা এবং দু-রকম মুসুর ডালের মিশিয়ে ধনশাকের ডাল তৈরি হয়। আলু, টমেটো, বেগুন, কুমড়ো এবং মেথিপাতা ইত্যাদি সবজি মিশিয়ে ব্রাউন রাইস রান্না করা হয়। ধনশাক রান্নার কেরামতি লুকিয়ে থাকে ধনশাক মশলায়। যা স্বাদে খানিক মিষ্টি, মিষ্টি!

 

foods2

উৎসবের মরশুমে তৈরি হয়, মোরি দার, সাল্লি গোস্ত, খারা রস, সল্লী বোটি, সল্লী মরঘি, পালেতি, পত্রনি মচ্ছি, সল্লী কিমা, প্ৰণ পেশিও, সঙ্গে থাকে মিঠ্ঠু দহি, সেভ, লগান্যু কাস্টার্ড এবং রাভোর মতো ডেজার্টও থাকে। ক্রিসমাস ও নববর্ষে রসনা তৃপ্তি ঘটায় 'সাল্লি চিকেন কারি', চিকেন কারির মধ্যে আলু ভাজা ও মশলা ছড়িয়ে দেওয়া। পার্সি নববর্ষে এ পাড়া অনন্য আকার ধারণ করে। তবে এতো খাবারের মাঝে পার্সিদের ব্রেকফাস্টের কথা না বললে অন্যায় হয়! পার্সি জলখাবারে থাকে পার্সিদের খাস অমলেট, পার্সি স্ক্র্যাম্বলড এগ এবং ডিম ও পাউরুটির যুগলবন্দীতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী পার্সি ব্রেকফাস্ট 'আকুরি'। মাওয়া কেক, নানখাটাই, মশলা বিস্কুট, পার্সি ঘরানার ফেটানো দুধের ফাটেলি কফি সঙ্গে পুরু মাখন দেওয়া বান রুটি বান মাস্কা, নানখাটাই, কিমা পাও, বম্বের বড়া পাও, মাংসের পুর ঠাসা বৈদা রুটি, ডিমপাগল পার্সিদের রীতি মেনে এডু বা ইডা তথা ডিম পোচে সেজে ওঠা পদ, চিজ ঠাসা পার্সি চিকেন কবিরাজি-কটলেটের জবাব নেই। আস্ত পমফ্রেটের পত্রানি মচ্ছি, চিংড়ির গরগরে প্যাটি বা আলুভাজা তথা সাল্লি ছড়ানো মাটন বোটি হল পার্সি খানার প্রাইড।​

 

foods3

বর্তমানে ​দারা এবং মেহর হনসোটিয়া, অর্থাৎ হনসোটিয়া দম্পতি এই অতিথিশালা চালাচ্ছেন। মেহের হানসোটিয়া জন্মসূত্রেই পার্সি। ধর্মশালার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে ২০১৩ সালে তিনি আর তাঁর স্বামী দারা আহমেদাবাদ থেকে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন প্রায় ৪০০ জন পার্সি। বহু পরিবারের সঙ্গেই মেলামেশা রয়েছে দারা-মেহেরের। মাঝে মাঝেই পার্টি হয় ধর্মশালায়। যাঁরা আসেন, প্রত্যেকে হয়ে যান মেহেরের রান্নার ভক্ত।

কিড স্ট্রিটের মনচারজি বা রুস্তমজি মানেকশ ধর্মশালা মানেই পার্সি খানার পীঠস্থান। তবে আরও এক আছে, কিন্তু বিপ্লব ঘটালেন পার্সি পরিবারের বধূ, বাঙাল মেয়ে সুপ্রিয়া মনচারজি। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই কলকাতা ছাড়ছেন পার্সিরা। কিন্তু আজও এ শহর পার্সি খানা প্রেমে মশগুল। সুপ্রিয়া পার্সি সমাজের নানা অনুষ্ঠানেও খাবার করেন। শহরের প্রবীণ পার্সিদের অনেকের বাড়িতেই নিয়মিত তাঁর রান্না যায়।

 

foods4

 

কিন্তু সাবেক বম্বের ইরানি কাফেগুলির আদলে পার্সি 'থিম রেস্তরাঁ' এই প্রথম এল কলকাতায়। মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদের পরে সোডাবটলওপেনারওয়ালারা এবার কলকাতায়। এখানে এলে তিন রকমের ডাল দিয়ে রান্না মাংসের ধানশাক, মাটন বেরি পুলাও, ঘন দুধের এলাচি ইরানি চা, এছাড়া ইরানি বেরি, মিষ্টি ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরিতেই অনন্য হয়ে ওঠা পার্সিদের পোলাও শেষ পাতের লগান নু কাস্টার্ড কিন্তু ট্রাই করবেনই করবেন। কলকাতা বহু ধর্ম জাতির মিলনক্ষেত্র, নানা জাতি নানা মতের খানার বৈচিত্র আমাদের তিলোত্তমায় মিশে অনন্য করে তুলেছে কলকাতার খানাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...