নিজের দেশ যদি কারও কাছে নিজের গর্ব হয়, তাহলে ফুটবল মাঠে বিপক্ষের স্বপ্ন ছিনিয়ে নেওয়ার আর এক নাম দেশঁ। নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া কোনও যুবককে আজ জিজ্ঞাসা করলে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। একবার নয় এমন কান্ড তিনি করেছেন দু'বার। একবার খেলোয়াড় হিসেবে আর একবার কোচ হিসেবে। তিনি দিদিয়ের দেশঁ।
১২ই জুলাই ১৯৯৮। ১৯৯০ সালে জন্ম নেওয়া কোনও ফুটবল পাগল বালকের কাছে তখন একটাই হিরো। রোনাল্ডো। বছর সাত আটের ছেলে আর কিছু না বুঝলেও রোনাল্ডোকে বোঝে। আর জানে ব্রাজিল। ১২ জুলাইয়ের সেই রাতে এমন কোটি কোটি ব্রাজিল ভক্তকে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন দেশঁ ও তাঁর দলের জিদান, ওঁরি, পেটি, ভিয়েরারা। প্যারিস সেন্ট ডেনিস। ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল। ফাইনালের আগে হঠাৎ অসুস্থ রোনাল্ডো। স্বপ্নের নায়ক রোনাল্ডো থাকবে কী দলে?
তিনি কী খেলতে পারবেন বিশ্বকাপ ফাইনাল? হঠাৎ জানা গিয়েছিল রোনাল্ডোর নাম টিমলিস্টে নেই। গোটা দুনিয়ার নজর তখন দু'জন মানুষের দিকে, যাদের একজন ব্রাজিলের দলের ডাক্তার লিডিও টলেডো আর অন্যজন দলের কোচ মারিও জাগালো। রোনাল্ডো নেমেছিলেন। কিন্তু দেশঁ তাকে বক্সে ঢুকতেই দিলেন না। সারা বিশ্বকাপে দুরন্ত ছন্দে থাকা রোনাল্ডো আটকে যান তাঁর পায়ের সামনে। এই রোনাল্ডো সক্কলের অচেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে।
বাকিটা ট্র্যাজেডি। জিদানের প্রথম গোলটা পেতির বাড়ানো বল থেকে, আর দু'নম্বরটা ছিল জোরকায়েফের কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে। ফ্রান্স শেষ কাঁটাটা পুঁতলো ইমানুয়েল পেতির নিজের করা গোলে। শেষ কিছু মিনিট ধরে ডেনিলসনের ফরাসি রক্ষণ ভেদ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা মাঠে মারা যায়। তারপর থেকে ব্রাজিল ভক্তরা দেশঁ বিরোধী।
কী করে মেনে নেয় দুঙ্গার চোখে জল? মানতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জাক শিরাকের সঙ্গে কাপ হাতে দিদিয়ে দেশঁ'র সেই ছবি। গোলপোস্টের নীচে উদাস চোখে তাকিয়ে ক্লদিও তাফারেল, তিনিই গত বিশ্বকাপে 'বাজ্জিও'র ইতালিকে কাপ থেকে কয়েক মাইল পেছনে ফেলে দিয়েছিলেন। টাইব্রেকারের সময় যিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সাম্বার দেশেও ভালো গোলকিপার জন্মায়! রোনাল্ডোকে সেবার 'গোল্ডেন বল' নিয়েই আশ্বস্ত হতে হয়েছিল। দুরন্ত ফুটবল থেকে বড় দুঃখের রাত উপহার দিয়েছিলেন দেশঁ।
ঠিক একই কারণে ২০১৮ সালে ফুটবল বিশ্বকাপেও নব্বইয়ের দশকের ব্রাজিল ভক্তরা চেয়েছিল কাপ যাক বিপক্ষের হাতে। আর দল যখন মদ্রিচ, পেরিসিচ, রাকিটিচ, মানজুকিচ, সুবাসিচদের ক্রোয়েশিয়া, তখন কাপ পাক তাঁরাই। কিন্তু দেশঁ থাকলে মনে হয় এসব 'বদদুয়া' কাজে লাগে না। আবারও ব্রাজিল ভক্তদের দুয়ো দিয়ে কাপ তোলেন দেশঁ। এবার কোচ হিসেবে।
এর সঙ্গেই মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে এক অনন্য রেকর্ড গড়েছিলেন ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশঁ। ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ জেতার পর কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, মারিও জাগালোর কীর্তিকে স্পর্শ করার হাতছানি ছিল দেশঁর সামনে। মস্কোর মেগা ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে সেই কীর্তি ছুঁয়ে ফেলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়কও ছিলেন দিদিয়ের দেশঁ।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালে ফুটবলার হিসেবে ও ১৯৯০ সালে কোচ হিসেবে দু'বারই জার্মানিকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের মতো ব্রাজিলের মারিও জাগালো ফুটবলার ও কোচ হিসেবে দু'বারই বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠেন। ১৯৫৮ সালে ফুটবলার হিসেবে এবং ১৯৭০ সালে কোচ হিসেবে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতেন তিনি।