শারীরিক সমস্যা ছিল। তিনি শরীর তাঁকে কাবু করতে পারেনি। হায়েনার মত ধূর্ত, বাঘের মতো ক্ষমতালোভী এবং সিংহের মতো পরাক্রম। নৃংশসতায় হার মেনে যায় পুরুষ। রাণী দিদ্দা। কাশ্মীরের এক ভুলে যাওয়া রাজললনা।
কঠোর শাসনে তাঁর রাজত্ব চলত। শোনা যায় এতটাই ক্ষমতালোভী ছিলেন যে নিজের তিন পৌত্রকে হত্যা করেছিলেন। ইতিহাস তাঁর সম্বন্ধে যে সাক্ষ্য দেয় সেই অনুযায়ী রাণী দিদ্দা সিংহাসন লোভী, ক্ষমতা আগ্রাসী এক শাসক চরিত্র।
কিন্তু সেই তথ্য কতদূর সঠিক সে নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই গিয়েছে। সত্যি কী তিনি এতটা প্রতিস্পর্ধী ছিলেন নাকি শাসক কেবল নারী এবং প্রবল তার প্রতাপ, এই কারণেই ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।
সংস্কৃত ভাষায় লেখায় কলহনের রাজতরঙ্গিনীর সূত্রে রাণী দিদ্দার শাসন কাল সম্বন্ধে বহু তথ্য মেলে। কলহন দ্বাদশ শতকের কাশ্মীরের ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন ‘রাজতরঙ্গিনী’তে।
রাজতরঙ্গিনীতে আরও বেশ কয়েকজন রাণীর উল্লেখ আছে। কিন্তু দিদ্দাকে সব চেয়ে কঠোর, উচ্চাকাঙ্খী এবং ক্ষমতালোভী হিসেবে এঁকেছিলেন তিনি।
অথচ রাজতরঙ্গিনী লেখা হয়েছিল দিদ্দার মৃত্যুর ১৪৫ বছর পর।
রাজতরঙ্গিনীর তথ্য অনুযায়ী দিদ্দা লোহারা রাজবংশের রাজা সিমহারাজার কন্যা। জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্জ ভূ-খন্ডের দক্ষিণাংশে তাঁর রাজত্ব ছিল।
২৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় প্রভাগুপের ছেলে কসেমা গুপ্তের সঙ্গে। কাশ্মীর উপত্যকায় প্রভাগুপ্তের তখন দারুণ প্রতাপ। তাঁর মৃত্যু হলে ৯৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে কসেমা গুপ্ত রাজা হন ।কিন্তু অচিরেই দেখা যায় যে রাজা হিসেবে তিনি খুবই দুর্বল। আকণ্ঠ মদ্যপান, শিকার আর দ্যূত ক্রীড়ায় মগ্ন থাকতে ভালবাসতেন। রাজ কাজে মন নেই। তাই কিছুটা বাধ্য হইয়েই রাজপাঠের হাল ধরতে হয় দিদ্দাকে।
কসেমা গুপ্ত এবং দিদ্দা দুজনের মিলিত নামে ‘দি-কাসেমা’ নামে মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল।
রাজপদে আসীন হওয়ার মাত্র ৮ বছরের মাথায় ৯৫৮ খ্রীস্টাব্দে কসেমাগুপ্তের মৃত্যু হয়। সে সময়ের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী দিদ্দার কাসমের সঙ্গে সতী হওয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে। কিন্তু সেই চাপের কাছে দিদ্দা অবনত হয়নি। শক্ত শিরদাঁড়ার মানুষ ছিলেন, সতী তিনি হননি। বরং আরও শক্ত হাতে রাজপাট সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পুত্র অভিমুন্যর অভিভাবক হিসেবে।
রাজপদে নারী এবং তার অঙ্গুলীহেলনকে খুব ভাল চোখে নেয়নি সে সময়ের সমাজ। দিদ্দার জন্য ক্ষ্মতা এবং জীবন যাপনের পথ আগাগোড়াই হয়ে উঠেছিল বিপদ সংকুল। নিজের মন্ত্রীসভার বেশির ভাগ মন্ত্রী তাঁর বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। চারদিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল বিদ্রোহ আর বিশ্বঘাতকতা। সে সবকে দমন করতে দিদ্দাকে কঠোর হতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর।
৯৭২-তে একমাত্র পুত্র অভিমুন্যের মৃত্যু হয়। আবার সিংহাসনের অভিভাবক হতে হয় রাণী দিদ্দাকে। তিন নাবালক নাতির হয়ে ক্ষমতাভার তাঁর। এই সময় থেকে অমিত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। বিশেষ করে পুঞ্জ আর রাজৌরিতে। এবার পাশে পান প্রধানমন্ত্রীকে।
রাণী দিদ্দার নামে সোনা ,রূপা এবং তাম্রমুদ্রা চালু হয়। মুদ্রায় লেখা ‘শ্রী দিদ্দা’। ভঙ্গীমা অনেকটা লক্ষ্মীর মতো।
৯৭৫-৯৮১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এর মধ্যে রাণী দিদ্দার ৩ পৌত্রের মৃত্যু হয়। পৌত্রদের মৃত্যু অনেকের কাছেই অস্বাভাবিক। ইতিহাসবিদরা দিদ্দার লোভের দিকে আঙ্গুল তোলেন। কলহনও তাঁর বইতে তেমনি ইঙ্গিত করেছেন।
পরবর্তী বাইশ বছর কাশ্মীর উপত্যকা শাসনকরেন তিনি। উপত্যকাকে সুশৃঙ্খল এবং সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিনত করেন।
১০০৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রাণী দিদ্দার ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র উদয়রাজা সিংহাসনে বসেন। ত
রাণী দিদ্দাকে ঘিরে নৃশংসতাঁর যে মিথ তাকে অনেকেই পুরুষতন্ত্রের ফসল বলে মনে করেন। একা রাণী র সুনিয়ন্ত্রিত রাজপাটকে অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে পারিষদ এবং রাজপরিবারের অন্দর। তাই ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।
কাশ্মীরের ইতিহাসবিদ জিএম রব্বানী তাঁর ‘অ্যানসিয়েন্ট কাশ্মীর’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন রাণী দিদ্দা তাঁর রাজত্বকালে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। সেটা শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায়’।