হলুদ পাতার ঝুরঝুরে একটা ডায়েরি। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭০০। গত ৭০ বছর ধরে ডায়েরিটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল নিউইয়র্কের গোপন লকারে।
শেষবার লেখা হয়েছিল ১৯৪২-এর ২৫ জুলাই। তার ঠিক পাঁচদিন পরেই গুলি করে মারা হয় ডায়েরির লেখিকাকে।
বিগত সত্তর বছর ধরে লুকিয়ে রাখার পর অবশেষে প্রকাশ্যে এসেছে সেই ঐতিহাসিক ডায়েরি ।
রেনিয়া স্পাইগেল। ১৫ বছর বয়সী এক ইহুদী কিশোরী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় রেনিয়া আর তাঁর বোন আরিনাকে। রেনিয়া রাশিয়ায় তাঁর দাদু-দিদার সঙ্গে থাকতেন।
এক সকালে তাঁদের নাৎসি ক্যাম্প গেটো-তে নিয়ে যাওয়া হয় বন্দি করে। সেখানে প্রায় কুড়ি হাজার ইহুদই বন্দি অবস্থায় ছিল।
১৯৩৯- এ তাঁর যখন পনেরো বছর বয়স তখন শুরু করেন ডায়েরি লেখা। ১৯৪২-এ মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে শেষ লেখা লেখেন। রেনিয়াকে নাৎসি সেনারা গুলি করে হত্যা করেছিল।
ডারেয়িতে রেনিয়ার শেষ লাইন ছিল, ‘তিনটে গুলি। তিনটে জীবন শেষ। গুলির শব্দগুলো কানে আসে। শুনতে পাই...’
ব্যাক্তিগত ডায়েরির পাতায় পাতায় রেনিয়া লিখে রাখত তার চারপাশের দুনিয়াটাকে। রেনিয়ার প্রাত্যহিক যাপনের গল্পে উঠে আসে আসত নাৎসি ক্যাম্পের অসহনীয় জীবনের কাহিনি।
রেনিয়ার ডায়েরি ইতিমধ্যেই ক্ল্যাসিক হলোকস্ট সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। নাৎসি অত্যাচার, যুদ্ধের ভয়াবহতা, মানুষের দুর্বিষহ জীবন উঠে এসেছে তাঁর লেখনির ছত্রে ছত্রে।
তাঁর বোন জানিয়েছেন, ‘ ওই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আমার এখন হাড়হিম হয়ে যায়। সেই সময়টা আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়।’
ট্রমা আর মানসিক যন্ত্রনায় দিদির ডায়েরি পড়তে পারতেন না বোন। মনে পড়ে যেত কনসনট্রেশন ক্যাম্পের স্মৃতি। তাই ব্যাঙ্কের লকারে রেখে আসেন।
রেনিয়ার সহোদরা বহুদিন পর্যন্ত নিজের পরিচয় আড়ালে রেখেছিলেন। তাঁর এক আত্মীয় জানিয়েছেন আমরা তাঁকে ‘আন্ট এলিজাবেথ’ নামেই চিনতাম।
কয়েক বছর আগে তাঁর পরিচয় এবং পারিবারিক ইতিহাস জানা যায়। সেই সূত্রেই সামনে আসে রেনিয়ার ডায়েরির কথা। পোলিশ ভাষায় লেখা ডায়েরিটি ইংরেজি অনুবাদের কাজ শুরু হয়।
রেনিয়ার ডায়েরি থেকে জানা যায় সদ্য কৈশোর পার হয়ে আসা দুই বোন নাৎসি অত্যাচারের মুখে প্রত্যেকদিন কীভাবে মৃত্যুর জন্য নিজেদের তৈরি করছে। চারপাশে অন্ধকার, মৃত্যু, আতঙ্ক, নাম হারিয়ে রাতারাতি শুধু নম্বর হয়ে ওঠা মানুষগুলো হঠাৎ কী করে একদিন গ্যাস চেম্বারের বাতাসে মিশে যায়। সেই নিষ্ঠুরতার কোনও নাম দেওয়া যায় না। রেনিয়া তাঁর দেখা কলমে ধরে রেখেছিলেন। যে ডায়েরির প্রথম পাতায় একদিন লেখা হয়েছিল কবিতার লাইন সেই ডায়রি থেমে গিয়েছিল যুদ্ধের দিনলিপিতে এসে।
রেনিয়ার ডায়েরি ‘হলোকস্টের জার্নাল’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছ। ১৯৩৯ জানুয়ারিতে রেনিয়া লিখেছিলেন, আমি এমন একজনকে খুঁজছি যাকে আমার ভয়ের কথা বলতে পারব। যাকে বলতে পারব আমার খুশির দিন গুলো কতটা ঝলমলে ছিল। আজ থেকে আমি এক বন্ধু খুঁজে পেলাম। যাকে আমি আমার সব কথা বলতে পারব। জানি না কখন ফুরিয়ে যাব। কে বলতে পারে আর কতটুকু সময় আমার হাতে আছে।
সেই ডায়েরির পরবর্তী সাতশো পাতায় সে নিজের জীবনের দিন-প্রতিদিনের গল্প লিখে গিয়েছিল।
প্রথম যেদিন নীল-সাদা স্ট্রাইপ পোশাক গায়ে উঠল, হাতে বাঁধা নম্বরের আর্মব্যন্ড, নিজেকেই চেনা যায় না। তার পুরনো জীবন থেকে অনেক দূরে স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারে কোনরকমে টিকে থাকা।
রেনিয়া লিখেছেন, ‘ যেদিকে তাকাই শুধু রক্তের দাগ। মৃত্যু আর হত্যা, লাশের মিছিল। আর্তনাদের শব্দটুকুও বোবা হয়ে গিয়েছে। এত ক্ষীণ বেঁচে থাকা।
হে ঈশ্বর আমাদের বাঁচতে দাও। আমরা বাঁচতে চাই...’